Ajker Patrika

জামানত যাচাই ছাড়াই খেলাপিদের বিপুল ঋণ

তানিম আহমেদ, ঢাকা
আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৪১
জামানত যাচাই ছাড়াই খেলাপিদের বিপুল ঋণ

একই মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কোনো ধরনের জামানত ও প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়ার তথ্য পেয়েছে জাতীয় সংসদের একটি সাব-কমিটি। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), সোনালী ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংক এবং দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ওপর পরিচালিত অনুসন্ধানে সাব-কমিটি এসব তথ্য পেয়েছে। সাব-কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও পারভেজ ইব্রাহিম, ফখরুল আলম, হামদি রাব্বিসহ কয়েকজনকে বিভিন্ন নামের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২৮৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শুধু ইব্রাহিমের নামে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা। গতকাল সোমবার সাব-কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাবসম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আব্দুস শহীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কমিটি পাঁচটি ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রদান ও আদায়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম দেখার জন্য একটি সাব-কমিটি গঠন করেছিল। সাব-কমিটি আজকের (সোমবার) বৈঠকে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এটা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব। দুর্নীতি হয়ে থাকলে প্রতিরোধ করার জন্য সুপারিশ করব।’

সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খানকে সভাপতি করে গঠিত সাব-কমিটির সদস্যরা হলেন আহসান আদেলুর রহমান ও খাদিজাতুল আনোয়ার। সাব-কমিটিকে সোনালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি), ন্যাশনাল ফিন্যান্স লিমিটেড (এনএফএল) এবং প্রিমিয়াম লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেডের (পিএলএফএল) খেলাপি ঋণসংশ্লিষ্ট আর্থিক অনিয়মের তথ্য যাচাই-বাছাই করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বলা হয়। সাব-কমিটি ছয়টি বৈঠকে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ অনুমোদন, আদায় ও সমন্বয়সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক আলোচনা করে। 

ঋণগ্রহীতাদের বেশির ভাগের স্বেচ্ছায় খেলাপি হওয়ার প্রবণতা ছাড়াও গ্রাহক নির্বাচন থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় অগ্রগতি পর্যালোচনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা ঋণ খেলাপ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ বলে সাব-কমিটি মনে করে। এ বিষয়ে ওয়াসিকা আয়শা খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, কমিটিতে আলোচনার পর সুপারিশগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হবে।

সাব-কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফখরুল আলম, হামদি রাব্বি, মো. পারভেজ ইব্রাহিম, মোহাম্মদ মনজুরুল আলম, ইফতেখার আলম, রায়হানা ইব্রাহিম, সৈয়দা সাইদা হায়দার, সাইফুল ইসলাম মিন্টু, ফাহমিদা মিজান—কোথাও একক নামে এবং কোথাও একাধিক নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও স্বত্বাধিকারী হিসেবে ঋণ নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ইব্রাহিম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, আরআই এন্টারপ্রাইজ, ঢাকেশ্বরী হাইটস লিমিটেড, টেক্সটাইল ভাচুসো লিমিটেড, সফট টেক, ওপাল ট্রেডিং হাউস, ইব্রাহিম রায়হানা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এক থেকে তিনটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ফিন্যান্স লিমিটেড, প্রিমিয়াম লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স লিমিটেড। এর মধ্যে শুধু ইব্রাহিম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নামে প্রথম তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলস লি. ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঋণখেলাপি হওয়ার পরও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) তথ্য যাচাই না করে এবং গ্রাহক সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার নিয়ম না মেনে পুনরায় ঋণ দিয়েছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধু ইব্রাহিম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুরুল আলম। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। কথা বলতে চেয়ে এসএমএস দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। এরপর তাঁকে এসএমএসে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। ইন্টারনেট থেক পাওয়া ল্যান্ড টেলিফোন নম্বরে কয়েকবার কল করা হয়েও সেটিকে টানা কয়েক ঘণ্টা ব্যস্ত পাওয়া গেছে। 

সোনালী ব্যাংকের অনেক গ্রাহকের খোঁজ মিলছে না
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনেক ঋণের অনুকূলে জামানত নেই। আর সিআইবিতে গ্রাহকদের হালনাগাদ তথ্য না থাকায় অনেক গ্রাহককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণ অনুমোদন ও ছাড়কারী একই ব্যক্তি হওয়ায় স্বচ্ছতা থাকছে না। ঋণগ্রহীতাদের অনেকে স্বেচ্ছায় খেলাপি হয়েছেন। 

বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি
প্রতিবেদন মতে, এসআইবিএলের বেশির ভাগ ঋণের অনুকূলে কোনো জামানত নেই। ব্যক্তিগত গ্যারান্টারের (নিশ্চয়তা দানকারী) মাধ্যমে ঋণগুলো দেওয়া হয়েছে। শ্রেণীকৃত ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১০ কোটি টাকার বেশি খেলাপিদের কাছে রয়েছে মোট ঋণের ৭০ শতাংশ। ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি বলে উল্লেখ করেছে সাব-কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২৭ জন খেলাপির কাছে ব্যাংকের বকেয়া ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকার বিপরীতে চলতি বছর (এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত) কোনো আদায় নেই। এই অবস্থা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক।’ 

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের বেশির ভাগ ঋণ জামানতবিহীন
প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণ ৬৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি। বেশির ভাগ ঋণ জামানতবিহীন। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স ও ট্যাক্স সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি। কিছু গ্রাহক অন্য প্রতিষ্ঠানেরও ঋণখেলাপি। এদের ক্ষেত্রে যাচাইবাছাই ঠিকমতো হয়নি। এসব প্রবণতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে সাব-কমিটি বলেছে, এগুলো যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 

বেশির ভাগই স্বেচ্ছায় খেলাপি
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের শতকরা ৭৮ ভাগই মন্দ ঋণ। এর মধ্যে ১২০ জন খেলাপির কাছে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা পাওনা আছে, যা ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের ৭৬ শতাংশ। প্রধানত জামানতবিহীন এসব ঋণ ব্যক্তিগত গ্যারান্টারের মাধ্যমে দেওয়া এবং ঋণগ্রহীতাদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছায় খেলাপি হয়েছেন। সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন (২০২১) অনুযায়ী, ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ক্ষতি ৭৪৬ কোটি টাকা। ২০০১ সালে লাইসেন্স পাওয়া ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডের মালিকানা বদলে যায় ২০০৮ সালে। এই প্রতিষ্ঠানের খেলাপিদের বেশির ভাগই ঋণ নেন ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। এসব গ্রাহক ২০০৬ ও ২০০৭ সালে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন বলে সাব-কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। 

পর্ষদের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিত করার সুপারিশ 
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিত করা এবং ঋণ প্রদানের নিয়মগুলো অনুপুঙ্খ মেনে চলার সুপারিশ করেছে সাব-কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় অঙ্কের ঋণ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানত রাখা, রক্ষিত জামানতের মান ও বাজার মূল্য সঠিকভাবে নির্ণয় ও যাচাই করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন করে জামানত নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, পরিচালন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাঠে ৪২৬ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৪৬ বিমা কোম্পানি

১০০ বছর পর জানা গেল ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রত্যঙ্গটি নারীর প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত