মামুনুর রশীদ
বর্ষপরিক্রমায় আবার আসছে মে দিবস। মে দিবস বহু বছর থেকেই ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেই একটা কর্মহীন দিন, রাস্তাঘাটে যানজট কম। অল্পসংখ্যক কিছু মিছিল, ট্রাকে করে কিছু শ্রমিকের যাতায়াত এবং কিছু স্লোগান শুনতে পাওয়া যায়। জেলা শহরগুলোতে পরিবহনশ্রমিকদের মধ্যাহ্নভোজ, সঙ্গে নেতা ও মালিকদের ছোট ছোট সভা—এসবের মধ্যেই পালিত হয় মে দিবস।
একদা এই শহরে মে দিবস পালিত হতো বেশ জমজমাট মিছিল, সভা এসবের মধ্য দিয়ে। এখন তা নিষ্প্রভ হয়ে উঠেছে। শুনেছি কলকাতা শহরে মে দিবসের আয়োজন ছিল শ্রমিকশ্রেণির একটা বড় প্রেরণা। শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিটাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। বিভিন্ন রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় এবং বিভিন্ন শহরে মে দিবস পালনের ছবি দেখে আমাদের দেশের সচেতন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিকশ্রেণি আশায় বুক বাঁধত।
শিল্প-সাহিত্যে মে দিবস একটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছিল। মে দিবস ও শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতি নিয়ে বহু কালজয়ী নাটকের জন্ম হয়েছিল। দিল্লির উপকণ্ঠে প্রতিবাদী নাটক করতে গিয়ে মালিকশ্রেণির গুন্ডার হাতে নিহত হন সফদার হাশমি। তা নিয়ে সারা উপমহাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তার নাটক অভিনীত হতে থাকে সর্বত্র।
আমাদের দেশেও আশির দশকের শুরু থেকে মে দিবস সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি জায়গা করে নেয়। আমাদের দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পথনাটক তখন একটা শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন আরণ্যক নাট্যদল মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে প্রতিবছর নতুন নাটক, গান, বক্তৃতা, আবৃত্তি ও প্রকাশনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনও দিনটি উদ্যাপনে বিভিন্ন স্থানে নাট্যানুষ্ঠান করে থাকে। পরবর্তীকালে পথনাটক পরিষদও তা অনুসরণ করে, ঋষিজও প্রতিবার মে দিবসে গান গেয়ে শ্রমিকশ্রেণির চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে আসছে। এই সঙ্গে গণসংগীতের দলগুলোও বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে থাকে।
মে দিবস পালনের একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দিনের ইতিহাস তুলে ধরা, শ্রমজীবী মানুষের ওপর নিপীড়নের একটা শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশ এবং সবচেয়ে মুখ্য বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্কৃতিতে মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলা। পশ্চিমা দুনিয়ায় শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেও উপমহাদেশে এখনো তা সুদূরের স্বপ্ন থেকে গেছে। শ্রমজীবী মানুষকে এখনো আমরা সম্মানের আসনে বসাতে পারিনি। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মেহনতি মানুষের রাজনীতি হলেও শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠেনি। এই সংস্কৃতির কাজটিকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব খুব একটা গুরুত্ব দেননি। একটা চিন্তার জগৎ যে গড়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, সেদিকে নজর না দিয়ে মজুরি, সুযোগ-সুবিধা এসবই মুখ্য বিষয় হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য তা প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে তাঁদের যে একটা যোগাযোগ তৈরি করা প্রয়োজন ছিল, তা এ দেশে গৌণই রয়ে গেছে।
১৯৪২ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ নাটক, চিত্রকলা, সংগীত, সাহিত্য—এসবকে গুরুত্ব দিয়ে একটা বিশাল আন্দোলন ও জনচেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকজুড়েই এ আন্দোলন চলেছিল। এর মধ্যে শাসকগোষ্ঠী দেশভাগের ঘটনায় পুরো ব্যাপারটাকে গুরুত্বহীন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু মানুষের চেতনার গভীরে পৌঁছে যাওয়ার ফলে তার ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শিল্প-সাহিত্যে তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলার কারণেই একটা সুসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি ও তার রাজনীতি গড়ে উঠেছে। যদিও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের ফলে সেখানেও ক্রমেই শ্রমিকশ্রেণির শিল্প-সাহিত্য নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপর্যয় হলেও শিল্প-সাহিত্যে তার ধারণাটি চলমান; বিশেষ করে নাটকে। কারণ, নাটক দারুণভাবে রাজনৈতিক। মানুষের কথা বলতে গেলে সেখানেই শ্রমিকদের নিপীড়ন, বঞ্চনা এবং বৈষম্য এসে যায়। পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে গিয়ে সন্ত্রাস এসে দাঁড়ায়। এসব বিষয়বস্তু ছাড়া নাটক হয় না। তাই সারা পৃথিবীতে নাটকের বিষয়বস্তু এখনো দ্বন্দ্বই মুখ্য বিষয়। বহুকাল ধরেই কালজয়ী নাটকের কাহিনি রচিত হয়েছে মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব নিয়েই। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শ্রেণিকাঠামো। তাই যেকোনো নাট্যকর্মী যখন চারদিকে তাকান, প্রথমেই তাঁর চোখে পড়ে এক অমানবিক শ্রেণিবৈষম্য। সেখান থেকেই সাধারণত নাট্যকার, পরিচালকেরা অনুপ্রাণিত হন এবং শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে দাঁড়িয়ে যান।
কার্ল মার্ক্স কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই শ্রমিকশ্রেণির শিল্প-সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাশিয়ার ঔপন্যাসিক, কবি, গল্পকার, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকারদের কাজে গভীরভাবে বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছিল। বিশ্বের দেশে দেশে তাই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’র নাট্যরূপ অভিনীত হয়েছে। চেখভের নাটক, তলস্তয়ের ছোটগল্প এবং উপন্যাসের নাট্যরূপ ও চলচ্চিত্রায়ণ করা হয়েছে। রাশিয়ার বাংলা প্রকাশনা প্রভূতভাবে সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ ও লেখকের মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া এ বিষয়ে কেউ তেমন কথা বলেননি। বহু বছর ধরে বদরুদ্দীন উমর, হায়দার আকবর খান রনো ছাড়া এ বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কেউ চর্চা করেননি। অনেকেই পার্টির ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ করলেও এদিকে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তাই অনন্যোপায় হয়েই কিছু নাট্যদল, সংগীতের সংগঠনকে একেবারেই দলবহির্ভূত হয়ে উদ্যোগ নিতে হয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে প্রগতিশীল দলগুলো এ বিষয়ে কাউকে তেমন কোনো সহযোগিতাও করেনি। যাই হোক, মানুষের চেতনার গভীরে এবং জীবনযাপনের মধ্যে যদি মে দিবসকে প্রতিষ্ঠিত না করা যায়, তাহলে শ্রমের মর্যাদা ও কর্মসংস্কৃতি কখনো গড়ে উঠবে না।
ভাবলে অবাক লাগে, এ দেশেই ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর যা কিছু ঘটেছে তা শ্রেণিসংগ্রামের এক জ্বলন্ত ইতিহাস। প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিয়ে দাঙ্গা, লাখ লাখ মানুষের দেশত্যাগ, লুণ্ঠন এবং সম্পদ আহরণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ক্রমাগত লুণ্ঠন এবং প্রথমেই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আক্রমণ এক নিষ্ঠুরতার বড় উদাহরণ। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তাকে অনুসরণ করেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুধু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেই থেমে থাকেনি, সামরিক শাসন জারি করে এ দেশের মানুষের অধিকার ও সম্পদকে গ্রাস করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্র, জনতা, কৃষক-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে, যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে জন্মলাভ করে। সেই সময়ের নেতারা যে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্ম দেন, তা পক্ষান্তরে শ্রেণিসংগ্রামেরই প্রতিফলন।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়নি। একধরনের লুটেরা পুঁজি, সামরিক শাসন এবং অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। সেখানে একমাত্র উচ্চকণ্ঠ ছিল ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এই সময়ে প্রথমে গোপনে এবং পরে অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তি তৎপর হতে থাকে। এই তৎপরতা একপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে অধিকার করে ফেলে। মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ইংরেজি শিক্ষা সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ইতিহাসের গতিধারা উল্টো দিকে প্রবাহিত করার প্রয়াস পায়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির বাস্তব ও প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলো উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে, যেখানে রাষ্ট্র এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকদের উদাসীন দেখা যায়। এই উদাসীনতার ফলে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে একধরনের বিদেশি অপসংস্কৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে এবং জনজীবনকে অনিরাপদ করে তুলছে। এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন।
শুধু দিবস পালনের সংস্কৃতিকে বর্জন করে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পয়লা বৈশাখ, মে দিবস এবং বিজয় দিবসের সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এ দেশের সব চিন্তাশীল-প্রগতিশীল মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুব প্রয়োজন।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
বর্ষপরিক্রমায় আবার আসছে মে দিবস। মে দিবস বহু বছর থেকেই ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেই একটা কর্মহীন দিন, রাস্তাঘাটে যানজট কম। অল্পসংখ্যক কিছু মিছিল, ট্রাকে করে কিছু শ্রমিকের যাতায়াত এবং কিছু স্লোগান শুনতে পাওয়া যায়। জেলা শহরগুলোতে পরিবহনশ্রমিকদের মধ্যাহ্নভোজ, সঙ্গে নেতা ও মালিকদের ছোট ছোট সভা—এসবের মধ্যেই পালিত হয় মে দিবস।
একদা এই শহরে মে দিবস পালিত হতো বেশ জমজমাট মিছিল, সভা এসবের মধ্য দিয়ে। এখন তা নিষ্প্রভ হয়ে উঠেছে। শুনেছি কলকাতা শহরে মে দিবসের আয়োজন ছিল শ্রমিকশ্রেণির একটা বড় প্রেরণা। শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিটাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। বিভিন্ন রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয় এবং বিভিন্ন শহরে মে দিবস পালনের ছবি দেখে আমাদের দেশের সচেতন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিকশ্রেণি আশায় বুক বাঁধত।
শিল্প-সাহিত্যে মে দিবস একটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছিল। মে দিবস ও শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতি নিয়ে বহু কালজয়ী নাটকের জন্ম হয়েছিল। দিল্লির উপকণ্ঠে প্রতিবাদী নাটক করতে গিয়ে মালিকশ্রেণির গুন্ডার হাতে নিহত হন সফদার হাশমি। তা নিয়ে সারা উপমহাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তার নাটক অভিনীত হতে থাকে সর্বত্র।
আমাদের দেশেও আশির দশকের শুরু থেকে মে দিবস সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি জায়গা করে নেয়। আমাদের দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পথনাটক তখন একটা শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন আরণ্যক নাট্যদল মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে প্রতিবছর নতুন নাটক, গান, বক্তৃতা, আবৃত্তি ও প্রকাশনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনও দিনটি উদ্যাপনে বিভিন্ন স্থানে নাট্যানুষ্ঠান করে থাকে। পরবর্তীকালে পথনাটক পরিষদও তা অনুসরণ করে, ঋষিজও প্রতিবার মে দিবসে গান গেয়ে শ্রমিকশ্রেণির চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে আসছে। এই সঙ্গে গণসংগীতের দলগুলোও বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে থাকে।
মে দিবস পালনের একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দিনের ইতিহাস তুলে ধরা, শ্রমজীবী মানুষের ওপর নিপীড়নের একটা শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রকাশ এবং সবচেয়ে মুখ্য বিষয় হচ্ছে কর্মসংস্কৃতিতে মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলা। পশ্চিমা দুনিয়ায় শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেও উপমহাদেশে এখনো তা সুদূরের স্বপ্ন থেকে গেছে। শ্রমজীবী মানুষকে এখনো আমরা সম্মানের আসনে বসাতে পারিনি। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মেহনতি মানুষের রাজনীতি হলেও শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠেনি। এই সংস্কৃতির কাজটিকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব খুব একটা গুরুত্ব দেননি। একটা চিন্তার জগৎ যে গড়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, সেদিকে নজর না দিয়ে মজুরি, সুযোগ-সুবিধা এসবই মুখ্য বিষয় হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য তা প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে তাঁদের যে একটা যোগাযোগ তৈরি করা প্রয়োজন ছিল, তা এ দেশে গৌণই রয়ে গেছে।
১৯৪২ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ নাটক, চিত্রকলা, সংগীত, সাহিত্য—এসবকে গুরুত্ব দিয়ে একটা বিশাল আন্দোলন ও জনচেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকজুড়েই এ আন্দোলন চলেছিল। এর মধ্যে শাসকগোষ্ঠী দেশভাগের ঘটনায় পুরো ব্যাপারটাকে গুরুত্বহীন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু মানুষের চেতনার গভীরে পৌঁছে যাওয়ার ফলে তার ধারাবাহিকতা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শিল্প-সাহিত্যে তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলার কারণেই একটা সুসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি ও তার রাজনীতি গড়ে উঠেছে। যদিও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের ফলে সেখানেও ক্রমেই শ্রমিকশ্রেণির শিল্প-সাহিত্য নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপর্যয় হলেও শিল্প-সাহিত্যে তার ধারণাটি চলমান; বিশেষ করে নাটকে। কারণ, নাটক দারুণভাবে রাজনৈতিক। মানুষের কথা বলতে গেলে সেখানেই শ্রমিকদের নিপীড়ন, বঞ্চনা এবং বৈষম্য এসে যায়। পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে গিয়ে সন্ত্রাস এসে দাঁড়ায়। এসব বিষয়বস্তু ছাড়া নাটক হয় না। তাই সারা পৃথিবীতে নাটকের বিষয়বস্তু এখনো দ্বন্দ্বই মুখ্য বিষয়। বহুকাল ধরেই কালজয়ী নাটকের কাহিনি রচিত হয়েছে মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব নিয়েই। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন শ্রেণিকাঠামো। তাই যেকোনো নাট্যকর্মী যখন চারদিকে তাকান, প্রথমেই তাঁর চোখে পড়ে এক অমানবিক শ্রেণিবৈষম্য। সেখান থেকেই সাধারণত নাট্যকার, পরিচালকেরা অনুপ্রাণিত হন এবং শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে দাঁড়িয়ে যান।
কার্ল মার্ক্স কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই শ্রমিকশ্রেণির শিল্প-সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাশিয়ার ঔপন্যাসিক, কবি, গল্পকার, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকারদের কাজে গভীরভাবে বিষয়গুলো প্রতিফলিত হয়েছিল। বিশ্বের দেশে দেশে তাই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’র নাট্যরূপ অভিনীত হয়েছে। চেখভের নাটক, তলস্তয়ের ছোটগল্প এবং উপন্যাসের নাট্যরূপ ও চলচ্চিত্রায়ণ করা হয়েছে। রাশিয়ার বাংলা প্রকাশনা প্রভূতভাবে সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ ও লেখকের মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া এ বিষয়ে কেউ তেমন কথা বলেননি। বহু বছর ধরে বদরুদ্দীন উমর, হায়দার আকবর খান রনো ছাড়া এ বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কেউ চর্চা করেননি। অনেকেই পার্টির ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ করলেও এদিকে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তাই অনন্যোপায় হয়েই কিছু নাট্যদল, সংগীতের সংগঠনকে একেবারেই দলবহির্ভূত হয়ে উদ্যোগ নিতে হয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে প্রগতিশীল দলগুলো এ বিষয়ে কাউকে তেমন কোনো সহযোগিতাও করেনি। যাই হোক, মানুষের চেতনার গভীরে এবং জীবনযাপনের মধ্যে যদি মে দিবসকে প্রতিষ্ঠিত না করা যায়, তাহলে শ্রমের মর্যাদা ও কর্মসংস্কৃতি কখনো গড়ে উঠবে না।
ভাবলে অবাক লাগে, এ দেশেই ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর যা কিছু ঘটেছে তা শ্রেণিসংগ্রামের এক জ্বলন্ত ইতিহাস। প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিয়ে দাঙ্গা, লাখ লাখ মানুষের দেশত্যাগ, লুণ্ঠন এবং সম্পদ আহরণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ক্রমাগত লুণ্ঠন এবং প্রথমেই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আক্রমণ এক নিষ্ঠুরতার বড় উদাহরণ। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তাকে অনুসরণ করেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পরবর্তীকালে সব রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুধু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেই থেমে থাকেনি, সামরিক শাসন জারি করে এ দেশের মানুষের অধিকার ও সম্পদকে গ্রাস করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্র, জনতা, কৃষক-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে, যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে জন্মলাভ করে। সেই সময়ের নেতারা যে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্ম দেন, তা পক্ষান্তরে শ্রেণিসংগ্রামেরই প্রতিফলন।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়নি। একধরনের লুটেরা পুঁজি, সামরিক শাসন এবং অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। সেখানে একমাত্র উচ্চকণ্ঠ ছিল ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এই সময়ে প্রথমে গোপনে এবং পরে অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তি তৎপর হতে থাকে। এই তৎপরতা একপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে অধিকার করে ফেলে। মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ইংরেজি শিক্ষা সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ইতিহাসের গতিধারা উল্টো দিকে প্রবাহিত করার প্রয়াস পায়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির বাস্তব ও প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলো উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে, যেখানে রাষ্ট্র এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকদের উদাসীন দেখা যায়। এই উদাসীনতার ফলে বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে একধরনের বিদেশি অপসংস্কৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে এবং জনজীবনকে অনিরাপদ করে তুলছে। এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন।
শুধু দিবস পালনের সংস্কৃতিকে বর্জন করে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পয়লা বৈশাখ, মে দিবস এবং বিজয় দিবসের সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এ দেশের সব চিন্তাশীল-প্রগতিশীল মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুব প্রয়োজন।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ দিন আগেগাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪দেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২০ নভেম্বর ২০২৪