Ajker Patrika

বেঁচে থাকার সার্কেল সম্পর্কে জানতে হবে

আলম শাইন
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২২, ০৯: ৫০
বেঁচে থাকার সার্কেল সম্পর্কে জানতে হবে

সমগ্র প্রাণিকুলকে বেঁচে থাকতে হলে একটা সার্কেলের প্রয়োজন। আর সেই সার্কেলটিই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আরও সহজ করে বলতে গেলে ‘পরজীবী’ শব্দটা ব্যবহার করা যায়; যদিও এ ক্ষেত্রে পরজীবী মানানসই নয়। ফলে আরও পরিষ্কার করে বলতে হচ্ছে বিষয়টি; অর্থাৎ এক প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলে অন্য প্রজাতির ওপর নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের মূল বিষয়। এই সার্কেলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষ।

মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রথম প্রয়োজন খাদ্য ও ওষুধের; যা আহরিত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য থেকেই। যেমন সহজ উদাহরণ হচ্ছে, মানুষ খায় হাঁস, হাঁস খায় মাছ, মাছ কেঁচো খায়...ইত্যাদি ইত্যাদি; অর্থাৎ রিসাইকেল বলতে যা বোঝায়, সেটিই জীববৈচিত্র্য। সুতরাং আমরা বলতে পারি, শুধু আমাদের দেশের জন্যই জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব আধিক্য নয়; সমগ্র বিশ্বেই রয়েছে এই জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা। জীববৈচিত্র্য নিয়ে জানলে যেমন একজন মানুষ সচেতন হবেন, তেমনি অন্যকেও বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হবেন। তাতে করে মানুষ জীববৈচিত্র্য নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাববেন এবং সতর্ক হতে পারবেন; অন্যকেও সতর্ক করতে সক্ষম হবেন।

আমরা জানি, বিশ্বে বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি কর্কটক্রান্তি এবং মকরক্রান্তির মাঝামাঝি এলাকা মেগাডাইভারস হিসেবে বিবেচিত। এখানেই সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আর তেমন একটি অঞ্চলই হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। সেই হিসেবে আমরা অনেকটাই সৌভাগ্যবান বলতে পারি। কিন্তু অনেকেই বিষয়টির মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি আজ অবধি। ফলে অহেতুক জীবের বিনাশ ঘটাচ্ছে। কারণে-অকারণেই এ কাজটি করছে তারা। যে পোকা বা পতঙ্গটি মারার দরকার নেই; অথচ ওকে জুতার নিচে ফেলে পিষে মারছে।

আবার পুড়িয়েও মারা হচ্ছে। আগাছা দমনের অজুহাতে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে জীববৈচিত্র্যে আঘাত হানছে অনেকেই। সত্যি বলতে, এ ধরনের জঘন্য কাজের অভ্যাস কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি মানুষের। জন্মের পর, অর্থাৎ জ্ঞান হওয়া অবধি থেকে এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়েছে তারা। দেখতে বিশ্রী একটা পোকাকে মেরে ফেলতেই হবে; অমন মানসিকতা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছে তাদের। বাবা-মা মেরেছেন, তাকেও মারতে হবে, না হলে পোকাটা ক্ষতি করতে পারে। এমন ধারণা থেকেই এ মানসিকতার জন্ম হয়েছে। অকারণে বন্য প্রাণী নিধন, পাখির মাংস খাওয়া কিংবা পোকামাকড় মারার ঘটনাগুলো দেখে দেখে রপ্ত করে ফেলায়, এখন চট করে তা পরিহার করা যাচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে তুচ্ছ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে যে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা আমাদের অজানার কারণে এত সব সর্বনাশ কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে।

আলম শাইনআমরা জানি দুই বাংলার সমগ্র অঞ্চলই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপে জীববৈচিত্র্যে ঠাসা। প্রথমে আমরা সুন্দরবনের হিসাব-নিকাশে যাচ্ছি। দুই বাংলাব্যাপী সুন্দরবনের বিস্তৃতি হলেও বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের অরণ্যটি ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে জীববৈচিত্র্যের কারণে। অনেকের ধারণা, সুন্দরবন বিশ্বের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে সর্ববৃহৎ বিধায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পেয়েছে। আসলে তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এখানে জীববৈচিত্র্যের বিষয়টি প্রথম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বনটি যে আকারে বৃহৎ, সেটিও জরিপে এসেছে। দুইয়ে মিলেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পেতে সাহায্য করেছে।

যা-ই হোক, আমরা জানি সুন্দরবন একটি শ্বাপদসংকুল অরণ্য। এ অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এই জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। যার প্রধান কারণই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য!

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই সুন্দরবনেই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৪০ ভাগের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিস্ময়কর তথ্যই বটে! এর মধ্যে রয়েছে ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫০ প্রজাতির মাছ ছাড়াও রয়েছে হাঙর, কুমির, ডলফিন ও বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। জানা যায়, সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৮৭টি একবীজপত্রী, ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী, ১৭টি ফার্ন-জাতীয়, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল; যার প্রতিটি উদ্ভিদই জীববৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে টিকিয়ে রাখছে সুন্দরবনকে হাজার বছর ধরে।

সুন্দরবনের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান। জীববৈচিত্র্যে ঠাসা সেন্ট মার্টিন দ্বীপও। মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার পরিধির একটা দ্বীপ। অথচ দ্বীপটি যেন জীববৈচিত্র্যের স্বর্গরাজ্য। এক সমীক্ষায় জানা যায়, এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৫ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০০ প্রজাতির পাখি (দেশি ও পরিযায়ী মিলিয়ে), ৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৫ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। রয়েছে পাথুরে শিলা ও হরেক রকম শৈবালের রাজ্য। এ ছাড়া অসংখ্য নারকেলগাছ এবং কেয়া বনসহ নানান ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। এ কারণেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে বলা হয় বিশ্বের দুর্লভতম স্থানের একটি; বিশেষ করে স্বল্প আয়তনের আর কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য ও বহুল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এখানে এ তথ্যটিও উল্লেখ করতে হয় যে বিশ্বের দুর্লভতম একটি কাছিমের নাম ‘অলিভ টার্টল’, যেটা সেন্ট মার্টিনে দেখা যায়।

সব মিলিয়ে আমরা গর্বিত, অধিক জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বসবাস করতে পেরে। যদিও এর সারমর্ম বুঝতে সক্ষম নন অনেকেই। বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা, কীটপতঙ্গ দেখলেই মেরে ফেলা উচিত। সামান্য পোকামাকড়ও মানবজাতিকে বেঁচে থাকতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে, এই সত্যটা সবাইকে বোঝাতে হবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। কেবল বিশেষ দিবসে এর গুরুত্ব তুলে ধরলে চলবে না, সব সময়ই কমবেশি জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিতে হবে, তাহলেই রক্ষা পাবে আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বিশাল ভান্ডারটি। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই এই বিশাল ভান্ডারকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হাজার বছর ধরে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত