Ajker Patrika

কার্টুনিস্ট কুদ্দুস ভিন্ন ধারায় সত্য বলার মানুষ

পলাশ আহসান
Thumbnail image

বছর পাঁচ-ছয়েক ধরে এম এ কুদ্দুস ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্য। কিন্তু চেনা-জানা অনেক পুরোনো। ছাত্র অবস্থায় ফিচার পাতার লেখক হিসেবে যখন সংবাদে যাতায়াত, তখন থেকে। ঢাকায় আসার পর যখন নিয়মিত হলাম, তখন আরও যোগাযোগ বাড়ল। ফিচার বিভাগের ছোট্ট ঘেরার মধ্যে কাজের ফাঁকে চলে কমলেশদার অনির্ধারিত আড্ডা। সেটা তখন আমার কাছে বড় স্কুল। কারণ সেখানে সন্তোষ গুপ্ত, মকবুলার রহমানের মতো দিকপাল মাঝেমধ্যে আসেন। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সংবাদে কর্মরত আরও নানা গুণী মানুষেরা ‘হ্যালো’ বলে যান। সে রকম একটি জায়গায় গুণী কুদ্দুস ভাইকে আমার প্রথম চেনা।
যদিও কুদ্দুস ভাইয়ের কার্টুনের সঙ্গে আমার পরিচয় তিনি যখন সংবাদে আঁকতে শুরু করেছেন, তখন থেকে। তাঁর কাজ সেই সময় থেকে এখনো আমার কাছে বিস্ময়। আরও বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন, যেদিন কমলেশ দা আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। একটু হতাশই হয়েছিলাম। এই ছেলে কুদ্দুস! আমি ভেবেছিলাম তিনি হবেন গম্ভীর কোনো মানুষ, চোখে চশমা, কাঁধে ঝোলা। যা-ই হোক, সেই বিস্ময়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কখনো কমেনি। সংবাদে আমার কাজ বন্ধ হওয়ার পর যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। দেখা হতো কালেভদ্রে। প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার পর যোগাযোগটা বাড়ল। তিনি নির্বাচন শুরু করার পর সেটা সখ্যে পৌঁছাল।

দেখা হলেই অন্তত ৫ মিনিট কথা হতো। লম্বা আড্ডা তো হতোই। আমি জানতাম কয়েক বছর ধরে কুদ্দুস ভাই পারিবারিক নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেও দুর্দান্ত সব কার্টুন আঁকছিলেন। চাকরি করছিলেন পরিচিত প্রতিষ্ঠানে, কিন্তু অর্থকষ্ট তাঁকে ছাড়ছিল না। মাঝে একদিন হঠাৎ আড্ডা ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যান?’ বললেন, ‘চাকরির বাইরেও কিছু কাজ করতে হয়।’ কোথায়, কী কাজ জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তর দেননি। শুধু বললেন, ‘কী করব? ঢাকা শহরে নিয়মিত বেতন না হলে সংসার চালাব কীভাবে? ঢাকা শহরে টিকতে গেলে এসব কৌশল ছাড়া উপায় কী?’

নিজে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বড় নেতা। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। চাকরি করেছেন নামী প্রতিষ্ঠানে। অথচ তাঁর চলাফেরায় আমিও গত কয়েক বছর সচ্ছলতার ছাপ দেখিনি। প্রবল অর্থকষ্ট ছিল তাঁর। যে কারণে কৌশল করে জীবন চালানোর কথা স্বীকার করলেন নিজেই। আমি তো জানি তাঁর কৌশল কী হতে পারে। কাউকে কিছু এঁকে দেন হয়তো। অথবা কিছু একটা ডিজাইন করে দেন। এই কাজ তো আমাদেরও করতে হয়। নিজের বিশ্রামের সময় বাঁচিয়ে অনেকেই করেন। এতে কিছু টাকা পাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু কাজের চাপে শরীরটা খারাপের দিকে যায়। একদিন হুট করে বিদ্রোহ করে বসে।
কুদ্দুস ভাইয়ের শরীর বিদ্রোহ করেছে ঘুমের মধ্যে। শেষ লড়াই করার সুযোগটাও পেলেন না। হায় সাংবাদিক জীবন! শান্তিপূর্ণ ঠান্ডা মাথার জীবনযাপন হলে তো এমন হওয়ার কথা নয়। আর দশটা পেশায় একই রকম মেধা-যোগ্যতা নিয়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ কিন্তু এমন অভাবী জীবন কাটান না। একজন সাংবাদিককে সবাই চেনে। কারণে-অকারণে যোগাযোগও রাখে। কিন্তু তাঁর জীবনযাপনের খবর কেউ রাখে না। সাংবাদিকও মুখে একখানা হাসি ঝুলিয়ে সবার ভালোর জন্য খবর করে যান। তিনি যেন সুকান্তের সেই বাতিওয়ালা, যিনি সন্ধ্যায় রাজপথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরেন, অথচ নিজের ঘরেই যার নেই বাতি জ্বালানোর সামর্থ্য।

এসব অপ্রাপ্তি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তাঁর কথা মানেই তো হতাশা বিনিময়। তবু বুঝতাম তিনি হারছেন না। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত লড়াইয়ের ঝান্ডা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। সব অনিয়মের প্রতিবাদ তাঁর কাছে ছিল। সবশেষ কথা হয়েছিল দিন পনেরো আগে। সেদিনও ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন ইচ্ছেমতো কার্টুন করতে না পারার জন্য। বলছিলেন, ‘আমার কথা কেউ শুনল না। কেউ কার্টুন বুঝল না। আমাদের দেশে কার্টুন বোঝার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। কার্টুনের সমালোচনা বুঝলে দেশটা অন্য রকম হতে পারত।’ কুদ্দুস ভাই এই ক্ষোভ শুধু সেদিন না, সুযোগ পেলেই ঝাড়তেন। আমিও চুপচাপ শুনতাম। শুনতে ভালোই লাগত। প্রেসক্লাবে গেলে এখন এটাই সবচেয়ে বেশি মিস করব।

শেষ দিন আরও একটি প্রসঙ্গ এসেছিল। সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক বন্ধু রাশেদ মেহেদী। আমরা কুদ্দুস ভাইয়ের কার্টুন নিয়ে স্মৃতিচারণা করছিলাম। একপর্যায়ে আমরা বললাম, ‘আপনার কার্টুনগুলোর একটা অ্যালবাম থাকা দরকার ছিল।’ এই প্রস্তাবে তিনি খুব যে পাত্তা দিলেন, তা মনে হলো না। সেই মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘কত কার্টুনই তো আলোচিত হয়েছে। কত হুমকি-ধমকি। তারপরও কেউ সেই সব মনে রাখেনি। এখন আর এসব জমিয়ে কী হবে?’ আমরা বললাম, ‘থেকে যাবে আমাদের গণমাধ্যম ইতিহাসে।’ ওই দিন আলোচনা আর এগোয়নি। তিনি উঠে গেলেন।

বলতে দ্বিধা নেই, কুদ্দুস ভাই সত্যিকার অর্থেই মূল্যায়িত না হওয়া একজন গুণী শিল্পী। একটু ভিন্ন ধারায় সত্য বলার সাংবাদিক। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই ছিল প্রতিবাদী মানুষের সারিতে দাঁড়ানো। কোনো সৃষ্টিই সত্যের বিপক্ষে ছিল না। অথচ তিনি আমৃত্যু অতৃপ্তই থাকলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরেকটি সত্য স্পস্ট হলো। আমার দেশে সত্য বলা সাংবাদিক কখনো স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন না। এখনো অন্তত সেই কাঠামো তৈরি হয়নি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত