Ajker Patrika

পুষ্টিবঞ্চিত শিশুরা কীভাবে দেশের ভবিষ্যৎ গড়বে

আবু তাহের খান
পুষ্টিবঞ্চিত শিশুরা কীভাবে দেশের ভবিষ্যৎ গড়বে

শিশু বয়সে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার কারণে যে মানুষটি বড় হয়ে কাঙ্ক্ষিত মানের শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে সর্বোচ্চ মানের খেলোয়াড় বা ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠতে পারছেন না, সেই একই কারণে এ দেশের অন্য মানুষেরাও তেমনি সেরা বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক, শিক্ষক, আমলা কিংবা  রাজনীতিক হয়ে উঠতে পারছেন না। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) কর্তৃক পরিচালিত এবং অতিসম্প্রতি প্রকাশিত ‘জাতীয় জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ ’-এর তথ্য জানাচ্ছে, দেশের ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুই গ্রহণযোগ্য মানের পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না।

দেশের ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের ওপর পরিচালিত এ জরিপ থেকে বেরিয়ে আসা সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হচ্ছে এই, গ্রহণযোগ্য মানের পুষ্টিকর খাবারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ২০১৭-১৮ সালে যে হার ছিল ৩৫ শতাংশ, সেটাই এখন ২৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এখানে দুটি প্রশ্ন: এক. আজকের যে শিশুরা আগামী দিনে বিভিন্ন খাতে ও ক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে দেশ পরিচালনা করবে এবং দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের ৭১ শতাংশই যদি পুষ্টিহীন থাকে, তাহলে ওই পুষ্টিহীন পরিচালনা ও নেতৃত্বের আওতায় দেশ এগোবে কেমন করে?

দুই. গ্রহণযোগ্য মানের পুষ্টিপ্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে যদি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমে যায়, তাহলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক নির্ধারিত মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) অনুযায়ী বাংলাদেশ কি সঠিক পথে এগোচ্ছে কিংবা পথ সঠিক থাকলেও তার গতি কি সন্তোষজনক?

প্রথম প্রশ্নের জবাব যেহেতু কিছুটা বিস্তৃত হওয়ার কথা, তাই দ্বিতীয় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত আলোচনাটিই আগে করা যাক। শিশুর পুষ্টিহীনতার উল্লিখিত এ হার মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কী কারণে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমে গেল, সে কারণটি অবশ্যই খুঁজে দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হয়তো বলা হবে, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সময়ে অর্থনীতির ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, এর ফলেই এমনটি ঘটেছে। কথাটি পুরোপুরি যথার্থ নয়। বাংলাদেশে করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ; অর্থাৎ তত দিনে জরিপের আওতাধীন সময়কালের ২ বছর ৮ মাস পেরিয়ে গেছে।

অন্যদিকে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি; অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই জরিপের মেয়াদকাল (৩০ জুন ২০২২) শেষ হয়ে যায়। ফলে ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এসে শিশুর মানসম্মত পুষ্টি গ্রহণের হার যে এতটা কমে গেল, এর জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্যায্য, অদক্ষ, অমানবিক বণ্টন ও বাজারব্যবস্থা এবং এই অন্যায্য, অদক্ষতা ও অমানবিকতা যে এ ক্ষেত্রে কতটা প্রকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য দিয়েই সে বিষয়টিকে খানিকটা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১ হাজার ৮১৬ মার্কিন ডলার, যখন দেশের ৩৫ শতাংশ শিশু মানসম্মত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের সুযোগ পেত। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ৪৮ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৬৮৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হলেও শিশুর মানসম্মত পুষ্টিযুক্ত খাবার গ্রহণের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশে। তার মানে হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির (যারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ) আয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আয়-উপার্জন তেমন কিছুই বাড়েনি; বরং মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কমে গেছে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই শিশুর পুষ্টিকর খাবারপ্রাপ্তির ওপর তার যে ব্যাপকভিত্তিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সেখানে করোনা বা ইউক্রেন যুদ্ধের অবদান খুবই সামান্য। রাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিই এ ক্ষেত্রে মূল কারণ।

এবার প্রথম প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। পুষ্টিবঞ্চিত ওই ৭১ শতাংশ শিশু যখন বড় হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত ও ক্ষেত্র পরিচালনার দায়িত্বে এবং নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হবে, তখন তাদের সেই নেতৃত্ব ও পরিচালনার মান কেমন হবে? মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা প্রয়োগে সত্যি কি তাদের পক্ষে সম্ভব হবে সর্বোচ্চ গুণগত মানটুকু রক্ষা করা? কয়েকটি বহুল আলোচিত উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের ব্যাপারে একটি প্রমাণিত সাধারণ অভিমত এই যে, শারীরিক সামর্থ্যে বা স্ট্যামিনায় তাঁদের অধিকাংশই অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানুষ; শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্যের অভাবে তাঁদের অধিকাংশই উঁচু মানের খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারছেন না।

এ বিষয়টির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে শিশু বয়সে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া বা না পাওয়ার বিষয়টি। কারণ শিশু বয়সে একজন মানুষের দেহে ওই অন্তর্গত সামর্থ্যটি গড়ে না উঠলে পরে শত বাড়তি খাবার যোগ করেও পিছিয়ে পড়া সেই ঘাটতিটুকু আর পূরণ করা সম্ভব নয়। বিষয়টি একইভাবে অন্য সব পেশার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

শিশু বয়সে পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার কারণে যে মানুষটি বড় হয়ে কাঙ্ক্ষিত মানের শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে সর্বোচ্চ মানের খেলোয়াড় বা ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠতে পারছেন না, সেই একই কারণে এ দেশের অন্য মানুষেরাও তেমনি সেরা বিজ্ঞানী, সেরা গবেষক, সেরা উদ্ভাবক, সেরা শিক্ষক, সেরা আমলা কিংবা সেরা রাজনীতিক হয়ে উঠতে পারছেন না। প্রমাণ এই যে আমাদের রপ্তানি তালিকায় তৈরি পোশাক থাকলেও যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি নেই, অন্যের উদ্ভাবিত ফর্মুলায় তৈরি ওষুধ থাকলেও নিজেদের উদ্ভাবিত কোনো টিকা বা ওষুধ নেই, প্রায় কোটি সংখ্যায় শ্রমিক থাকলেও প্রকৌশলী বা কারিগরি বিশেষজ্ঞ নেই।

আর আমদানি তালিকায় ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি রয়েছে উচ্চ প্রযুক্তি ও তদভিত্তিক যন্ত্রপাতি, স্থল, জল ও আকাশপথে চলাচলকারী যানবাহন, কারিগরি বিশেষজ্ঞ, এমনকি কারখানা ও দপ্তরের সাধারণ পরিচালনকর্মীও। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে রয়েছে অন্য দেশ ও সংগঠনের সনদ ও সুপারিশপ্রাপ্তির নিরন্তর প্রত্যাশা। কিন্তু নিজেদের কর্ম, দৃষ্টান্ত ও সুপারিশকে অন্যের কাছে কাম্য, আকর্ষণীয় ও অনুকরণীয় করে তোলার কোনো আকাঙ্ক্ষাই কখনো আমাদের মধ্যে জন্মায় না। আমরা আসলে অন্যের কর্ম, চিন্তা, মেধা, উদ্ভাবন ও উৎপাদনের ভোক্তা ও ফলভোগী মাত্র, যার পেছনের একটি বড় কারণ হচ্ছে শিশুকালে ও বাড়ন্ত বয়সে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না পাওয়া।

এমনি পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ ’-এর তথ্যকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণপূর্বক দেশের সার্বিক পুষ্টিপরিস্থিতির উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে মনে করি। সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা এ জন্য যে চলতি কার্যক্রম ও কর্মসূচিতে কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা থাকার কারণেই বস্তুত দেশের পুষ্টিপরিস্থিতির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত হারে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না। ওই যে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের গ্রহণযোগ্য মানের পুষ্টিকর খাবারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক মাত্রার অবনতি ঘটল, সেটিও ওই ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতার কারণেই।

আর সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ত্রুটিটি থেকে যাচ্ছে বস্তুত রাষ্ট্রের আদর্শিক চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিকাঠামোর ক্ষেত্রে। রাষ্ট্র শুধু বিত্তবানের সামর্থ্যের আলোকে জনগণের পুষ্টিপরিস্থিতিকে বিবেচনা করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের পুষ্টিস্তরের সন্তোষজনক অগ্রগতি কখনোই এবং কিছুতেই অর্জন করা সম্ভব নয়।  

আগামী দিনের বাংলাদেশ যাতে একদল মেধাবী, দক্ষ ও সৃজনশীল চিন্তাচেতনা ও মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ মানুষের নেতৃত্বের আওতায় পরিচালিত হতে পারে, সে জন্য দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারপ্রাপ্তির বিষয়টি রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী বিত্তবানের স্বার্থের অনুগামী রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র সেটি করতে কতটা আগ্রহী হবে, সেটাই দেখার বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

বগুড়ায় ইফতারের পর ডেকে নিয়ে যুবককে হত্যা

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত