Ajker Patrika

পঞ্চাশেও পোক্ত হলো না মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়

আশরাফ-উল-আলম ও এস এম নুর মোহাম্মদ, ঢাকা
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯: ২৩
পঞ্চাশেও পোক্ত হলো না মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়

প্রিয় স্বদেশভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে প্রাণ বাজি রেখে লড়ে বিজয়ী হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল বাংলাদেশ। অথচ এই ৫০ বছরেও সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা গেল না বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সংজ্ঞা নির্ধারণে এখনো মামলা চলছে হাইকোর্টে।

বিভিন্ন সময়ে বীর ‘মুক্তিযোদ্ধার’ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এ সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। সবশেষে সরকারঘোষিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত জুনে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত। আইনজ্ঞরা মনে করেন, হাইকোর্ট রুল জারি করায় বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাটি আবারও ঝুলে গেল। আর এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও চূড়ান্ত হতে বিলম্ব হবে।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, হাইকোর্ট কবে রুল জারি করেছেন সেটি জানা নেই। তবে রুল জারি হয়ে থাকলে অবশ্যই জবাব দেওয়া হবে।

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সংসদে পাস হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করে লেখা আছে। বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞায় পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিডিআরের যারা যুদ্ধ করেছে, সেগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছি। তাদের ছাড়াও সরকারি কর্মচারী, বিদেশে জনমত তৈরিকারী, বীরাঙ্গনা এবং চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, রুল বিচারাধীন। তাই এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তবে মুক্তিযোদ্ধা কারা,

সেটা সবাই জানেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে ছয়বার বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে এখন গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৮। মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯৮২ জন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানী ভাতা ও চাকরির সময়সীমা এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের সন্তান, নাতি-নাতনির জন্য রয়েছে চাকরিতে কোটা-সুবিধা। আর তাই অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও তালিকাভুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই অবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ করে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এতে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’ এতে সরাসরি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্নভাবে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ আছে।

কিন্তু এই প্রজ্ঞাপন জারির পর দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নতুন সংজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ১৯৭২ সালের ৭ আগস্টে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঘোষণা করা সংজ্ঞাকেই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হিসেবে দেখতে চান। ওই সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, ‘কোনো একটি বাহিনীভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ব্যক্তিই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিগণিত হবে।’ ওই সংজ্ঞার আলোকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, মুক্তিবাহিনী, কে ফোর্স, জেড ফোর্স, এস ফোর্স ইত্যাদি বাহিনীভুক্ত হতে হবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে।

অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার মতে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসরণ করেই কেবল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা সম্ভব। আর তাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নরসিংদীর বেলাবোর এম আবেদ আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন ভূইয়া, মনোহরদীর মোহাম্মদ আলী মৃধা ও শহিদুল্লাহ ভূইয়া এবং রাজধানীর উত্তর মুগদার আবুল কাশেম গত ১৫ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ ২১ জুন রুল জারি করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় ঘোষিত বীর ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। এ ছাড়া লাল মুক্তিবার্তাসহ বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত সংজ্ঞার ভিত্তিতে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ব-বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম আজকের পত্রিকাকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সময়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুসারে তিন বাহিনীর বাইরে যাঁরা কোনো না কোনো বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতার ওই সংজ্ঞা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় পরিবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে যাঁরা যুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তালিকা করা হয়। লাল মুক্তিবার্তাকে দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর আইনগত কোনো অনুমোদন নেই। সরকারি প্রকাশনাও নয়। এসব বিবেচনায় আদালত রুল জারি করেছেন।

সংজ্ঞা নিয়ে রিট আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধা এম আবেদ আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে সুবিধাবাদীরা বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তন করেছে, তালিকাও দীর্ঘ করা হচ্ছে। নতুন সংজ্ঞায় গায়ক, বীরাঙ্গনা, নার্স, চিকিৎসক, খেলোয়াড়েরাও বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যাঁর যে অবদান, তার স্বীকৃতি হতে পারে, কিন্তু সরাসরি বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁদের স্থান দেওয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মেনে নিতে পারছেন না।’

ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ বলেন, তালিকা নিয়ে যে অরাজকতা হয়েছে তাতে করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থও হতে হয়েছে। আর সরকার পরিবর্তন হলে তালিকায় পরিবর্তন হয় কেন? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই এটা করা হয়। দ্রুত এই রুল নিষ্পত্তি করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুক বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কোটা, চাকরির বয়স ইত্যাদির মধ্যে ফেলে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ উৎসাহী হয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকতে। সেই জায়গা থেকে ৫০ বছরেও বের হতে না পারা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। এখন দ্রুত রুলটি নিষ্পত্তি করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৪ দাবি নিয়ে মার্কিন চাপ, বাংলাদেশের সায় ৩ শর্তে

গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপল্লিতে হামলাকারীদের উসকানি, স্থানীয় সাংবাদিক গ্রেপ্তার

রাজশাহী টেক্সটাইল মিলসে তৈরি হচ্ছে মানিব্যাগ, জুতা

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে চীনের তৈরি অত্যাধুনিক মাল্টিরোল অ্যাটাক হেলিকপ্টার জেট-১০

রাবিতে শিক্ষক নিয়োগে জামায়াত নেতার সুপারিশ, উপ-উপাচার্যের ফেসবুক থেকে ভাইরাল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত