Ajker Patrika

ট্রেনের টিকিটের জন্য হাহাকার, অথচ ৩২ শতাংশই বিক্রি হয় না

সৌগত বসু, ঢাকা
আপডেট : ২৭ জুন ২০২৪, ১৬: ৩৯
Thumbnail image

বাংলাদেশ রেলওয়েতে বছরে বিক্রিযোগ্য টিকিট বরাদ্দ থাকে কমবেশি ৫ কোটি ১০ লাখ। রেলমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৩ সালে রেলওয়ে টিকিট বিক্রি করেছে প্রায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ। সে হিসাবে টিকিট অবিক্রীত থেকেছে ১ কোটি ৬৫ লাখ, যা মোট টিকিটের ৩২ শতাংশ। টিকিট অবিক্রীত থাকায় বিপুল পরিমাণ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রেলওয়ে। যদিও আন্তনগর ট্রেনগুলোয় আসন ফাঁকা আছে এমন চিত্র সচরাচর দেখা যায় না। বরং কোনো কোনো রুটে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে ট্রেনগুলো।

রেলের এক-তৃতীয়াংশ টিকিট অবিক্রীত থাকার পেছনে বিনা টিকিটে যাত্রীদের ভ্রমণকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্টেশনে বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহনে বিশাল সিন্ডিকেট কাজ করে। ট্রেনের ভেতরে দায়িত্ব পালনকারী টিটিই, সিকিউরিটি গার্ড, আনসার সদস্য এবং খাবার বিক্রির কাজে নিয়োজিতরা এই সিন্ডিকেটের সদস্য। তারা বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামলে টাকার বিনিময়ে বিনা টিকিটের যাত্রী তোলেন ট্রেনে।

রেলওয়ে সূত্র জানা যায়, দেশে লোকাল, মেইল ও আন্তনগর ট্রেনের প্রায় অর্ধেক যাত্রীই টিকিট কাটেন না। শুধু কমলাপুর স্টেশন থেকেই দিনে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রী বিনা টিকিটে স্বল্প ও অধিক দূরত্বে ট্রেন ভ্রমণ করেন। সারা দেশে ১০৬টি আন্তনগর ট্রেনে যে সংখ্যক যাত্রী বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন, তাতে দিনে প্রায় ৫০ লাখ টাকা আয়বঞ্চিত হয় রেল। আন্তনগরের পাশাপাশি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনগুলোর বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে নিলে দৈনিক গড়ে ৩ কোটির টাকার বেশি আয়বঞ্চিত হচ্ছে রেলওয়ে। এ কারণে লোকসান থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রেল।

রেলওয়ের আয়ের প্রধান খাত যাত্রী পরিবহন। রেলের মোট আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন এবং ২০ শতাংশ আসে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে। ১০ জুন সংসদে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম জানিয়েছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের রেলওয়ে মোট ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। আর আয় ছিল ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এতে দেখা যায়, এক টাকা আয় করতে প্রায় দুই টাকা খরচ হচ্ছে রেলের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনা টিকিটে ভ্রমণ ও রেলের নিজস্ব আইটি পদ্ধতির উন্নতি না হওয়ার কারণে রেল টিকিট বিক্রি করতে পারছে না। চাহিদাসম্পন্ন রুটগুলোতে টিকিট বিক্রি হলেও সারা দেশে বেশির ভাগ স্টেশনে বিনা টিকিটে ভ্রমণের ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন,  সেবা নিশ্চিতের জায়গাগুলো খুবই সংকুচিত করে রেখেছে রেলওয়ে। সংস্থাটি একদিকে বলছে ইঞ্জিন ও কোচ সংকটে যাত্রী চাহিদা মেটাতে পারছে না, আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বিপুল টিকিট অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। বিনা টিকিটে যাত্রী ওঠার প্রবণতা কমাতে পারছে না রেল। এর জন্য তাঁদের শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এত দিনে রেলের একটি নিজস্ব কাঠামো দাঁড়ায়নি। যেসব টিকিট তারা অনলাইনে দিচ্ছে, সেটিও একটি থার্ড পার্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পাশের দেশে কিন্তু রেলে বিনা টিকিটে ভ্রমণের প্রবণতা অনেক কম। তারা সেভাবে তাদের ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। বিদেশে ট্রেনের টিকিট কিন্তু বিভিন্ন এজেন্টের কাছে উন্মুক্ত থাকে। সেখান থেকে যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের সাবেক এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, রেল কখনো চায় না টিকিট অবিক্রীত থাকুক। আন্তনগর ও কিছু ট্রেনের যে টিকিটগুলো অনলাইন ও কাউন্টারে বিক্রি হয়, সেগুলোর হিসাব থাকে। প্রাইভেট অনেক ট্রেনের টিকিটের হিসেবে রাখা অনেক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সেখানে ম্যানুয়ালি টিকিট বিক্রি হয়।

রেলে দিনে কত টিকিট বরাদ্দ, কত বিক্রি

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রেলে দিনে মোট টিকিট বরাদ্দ থাকে গড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার। তবে দিন-চাহিদাভেদে এই সংখ্যা ওঠানামা করে। আগামী ৪ জুলাইয়ের জন্য রেলের মোট বরাদ্দকৃত টিকিট আছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ২১০টি। আবার ৬ জুলাইয়ের জন্য আছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৬টি টিকিট। যদি গড়ে দৈনিক ১ লাখ ৪০ হাজার টিকিট ধরা হয়, তবে মাসে বরাদ্দ টিকিট দাঁড়ায় ৪২ লাখ, আর বছরে দাঁড়ায় ৫ কোটি ১১ লাখ। সারা দেশে অনলাইন ও কাউন্টারে আন্তনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি হয়। আন্তনগর ট্রেনের জন্য বরাদ্দ থাকে গড়ে ৭৫ হাজার টিকিট, যা মাসে দাঁড়ায় ২২ লাখ ৫০ হাজার ও বছরে ২ কোটি ৭৩ লাখ। আর বাকি টিকিটগুলো মেইল ও কমিউটার ট্রেনের। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রির বিষয়টি দেখে সহজ ডট কম। সারা দেশে ১০৫ টি স্টেশনের টিকিট বিক্রি করতে পারে তারা।

 এদিকে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৩টি টিকিট বিক্রি করেছে রেলওয়ে। এর মধ্যে ২ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার ৭৯৯ বিক্রি হয়েছে অনলাইনে, যা মোট টিকিটের ৬০ শতাংশ। আর ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ২৪৪টি টিকিট বিক্রি হয়েছে কাউন্টারে। এর আগে ২০২২ সালে অনলাইনে ৩৮ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছিল। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লাখ ৮৬ হাজার ৯৬০টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার ৭৮৯ টিকিট। বাকি ৬২ শতাংশ বিক্রি হয় কাউন্টার থেকে। এ থেকে দেখা যায়, রেলের মোট টিকিটের প্রায় অর্ধেক টিকিট অবিক্রীত থাকছে প্রতিবছর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, রেলের টিকিটের হিসাব এভাবে গড়ে করা যাবে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ দিনে পাঁচটি ট্রেন চলাচল করে। যদি আড়াই হাজার আসন থাকে তবে জামালপুর পর্যন্ত বিক্রি হয় ২০টা। কারণ ট্রেনটি যাবে দেওয়ানগঞ্জ। দেখা যাবে বেশির ভাগ যাত্রী জামালপুর নেমে যাচ্ছে। বাকি অল্প যাত্রী দেওয়ানগঞ্জ যাবে। তাই ওই কোটা ফিলআপ হচ্ছে না।

রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, বিনা টিকিটে লোক যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিনা টিকিটের যাত্রী ঠেকাতে হলে সারা দেশে রেলস্টেশনের চারপাশ বন্ধ করতে হবে। এটা না হলে সম্ভব না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত