Ajker Patrika

বেলাইনে ৪৮ আবাসন প্রতিষ্ঠান

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল, ঢাকা
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৩, ০৮: ১৯
Thumbnail image

বিধিবহির্ভূত কার্যক্রম চালানো ৪৮টি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে নোটিশ দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এগুলোর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল-ভরাট, অনুমোদন না নিয়েই বিজ্ঞাপন, প্লট বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নোটিশের জবাব না দেওয়ায় এগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) চিঠি দিয়েছে রাজউক। এই আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে।
বাকি ৩২টি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান আবাসন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নেওয়া নিবন্ধন দীর্ঘ বছর ধরে নবায়ন করছে না। রিহ্যাব বলছে, নামমাত্র জমি কিনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কাগজ-কলমে প্লট বিক্রি করে টাকা হাতানো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজউকের ফৌজদারি মামলা করা উচিত।

জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আনিছুর রহমান মিঞা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাজউকের সীমানার মধ্যে অনেক অবৈধ হাউজিং কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যেগুলোতে প্লট-ফ্ল্যাট কিনে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আমরা এগুলোকে চিহ্নিত করে নোটিশ দিয়েছি। খুব বেশি সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেব। এরপর হার্ড লাইনে যাব।’

রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে অনেক আবাসন কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এর বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চটকদার বিজ্ঞাপনে ক্রেতা আকৃষ্ট করে প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির নামে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এমন শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে রাজউকে। এসব আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নদী-খাল-বিল, খাসজমি দখল ও ভরাটের অভিযোগ রয়েছে।  

এ বিষয়ে নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজউক তার আইন অনুযায়ী অবৈধ আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু রাজউক শুধু কাগজই তৈরি করে। সরেজমিনে গিয়ে এগুলো বন্ধ করে না। আমরা এখন মনে করতেই পারি, কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অবৈধ আবাসন প্রকল্পে ক্রেতারা জেনেশুনেই প্লট-ফ্ল্যাট কেনেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, এখন যেটা অবৈধ, তা পরে বৈধ হয়ে যাবে। এমন নজির রাজউকই তৈরি করেছে। তাই রাজউকের হুমকি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি খুব একটা আমলে নেয় না।’ 

কেরানীগঞ্জের ১৬টি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ: রাজউকের সূত্র বলেছে, বিধিবহির্ভূত কার্যক্রম চালানো আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জেই আছে ১৬টি। সম্প্রতি রাজউক এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে নোটিশ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মিলিনিয়াম সিটি, মধু সিটি, ম্যাক্সওয়েল ওয়েস্টার্ন সিটি, সোপান দক্ষিণা সিটি, ঢাকা মডার্ন সিটি লিমিটেড, স্বপ্ন নিবাস, সাফা মাওয়া গ্রুপ, সবুজ ছায়া গ্রুপ, সানওয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড, অ্যাপোলো হাউজিং লিমিটেড, বসতভিটা ডেভেলপমেন্ট, সাফা গ্রিন সিটি, সাউথ টাউন, বিডিসি লিমিটেড, জাজিরা প্রকল্প, কেরানীগঞ্জ আটি মডেল টাউন।

এসব প্রতিষ্ঠানের বিধিবহির্ভূতভাবে প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রিসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মুহম্মদ কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ঢাকার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ (সংশোধিত ২০১২ ও ২০১৫), রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর বিধিবহির্ভূত প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন ও অবৈধভাবে বালু ভরাট কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে। এই ১৬টি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে সাত দিনের মধ্যে গৃহীত পদক্ষেপ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন না করেই বিধিবহির্ভূতভাবে প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ও অবৈধভাবে বালু ভরাটসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একজন কর্মকর্তা বলেন, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ধারা ২০ অনুযায়ী, অনুমোদন ছাড়া রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার। কোনো ডেভেলপার যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ শুরু করলে কিংবা অননুমোদিত রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচার বা বিক্রি করলে অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জানতে চাইলে সাউথ টাউনের সিনিয়র ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে মোট ৩ হাজার ৫০০ বিঘার প্রকল্প করার পরিকল্পনা রয়েছে। মোট ১৩টি সেক্টর করা হয়েছে। এ পর্যন্ত চারটি সেক্টরে বালু ভরাট শেষ হয়েছে। অনেক গ্রাহককে প্লট বুঝিয়ে দিয়েছি। রাজউক আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো নিশ্চিত করলে অনুমোদন পাওয়া যাবে। কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

রাজউক থেকে প্রকল্পের নামে কোনো চিঠি আসার বিষয়টি জানা নেই বলে জানান নিজেকে মধু সিটির ম্যানেজার পরিচয় দেওয়া হাসান মাহমুদ। ম্যাক্সওয়েল ওয়েস্টার্ন সিটির ডেপুটি ম্যানেজার মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘মোট ৬১৩ বিঘা জমির প্রকল্প আমাদের। ১০০ বিঘা জমি ভরাট করা হয়েছে। আরও ১০০ বিঘা ভরাটের কাজ হাতে নিয়েছি। প্রকল্পের রাজউকের অনুমোদন আছে কি না, তা আমার জানা নেই।’

সবুজ ছায়া গ্রুপের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার লিয়াকত হোসেন খান (সুমন) বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে সবুজ ছায়া গ্রুপের তিনটি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে সবুজ ছায়া গোল্ডেন সিটি পুরোপুরি বিক্রি শেষ। সবুজ ছায়া মেগা সিটি ও সবুজ ছায়া রিভার সিটির কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের প্রকল্প নিয়ে রাজউক গত ফেব্রুয়ারিতে ঝামেলা করেছিল। এরপর আর কিছু জানি না।’

এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিধিবহির্ভূত যারা কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা নোটিশ দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।’

আরও ৩২ রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ: বিধি অনুযায়ী, যাঁরা রাজউক থেকে আবাসন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিবন্ধন নিয়েছেন, তাঁরা প্রতি বছর তা নির্ধারিত ফি দিয়ে নবায়ন করবেন। কিন্তু কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লি., ক্যাপিটাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি., কনকর্ড রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রোডাক্টস লি., জেনোভ্যালী মডেল টাউন প্রাইভেট লি., নর্দান হোল্ডিংস লিমিটেড, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি., বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড রোডস ডেভেলপমেন্ট লি. (বার্ড), সেঞ্চুরি রিয়্যালটি লিমিটেড, কনকর্ড আর্কিটেকস অ্যান্ড ইন্টেরিয়র ডেকর লিমিটেড, আরশিনগর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, শরীফ হাউজিং কোম্পানি, পাইওনিয়ার হোল্ডিংস লিমিটেড, নতুনধারা হাউজিং কোম্পানি লিমিটেড, শান হোল্ডিংস লিমিটেড, শাহজালাল লেক ভিউ হাউজিং (প্রাইভেট) লিমিটেড, আরবান প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড, হাজী গফুর ল্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড, আইকাব হাউজিং কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড, শেলটেক (প্রাইভেট) লিমিটেড, হীরাঝিল প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রাইভেট) কোম্পানি লিমিটেড, উত্তরণ প্রোপার্টিজ লিমিটেড, সাফা মারওয়া হাউজিং লিমিটেড, সবুজ ছায়া আবাসন প্রজেক্ট লিমিটেড, গ্লোরিয়াস ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লি., কপোতাক্ষ গ্রিনসিটি লি., ট্রাস্ট ডেভেলপার্স, টাইটানিক হোল্ডিংস লি., ইনোভেটিভ হোল্ডিংস লি., জলসিঁড়ি আবাসন (প্রাইভেট) লিমিটেড দীর্ঘ সময় ধরে নিবন্ধন নবায়ন করছে না। এগুলোকেও নোটিশ দিয়েছে রাজউক।

রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি কামাল মাহমুদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকার আশপাশে শত শত আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরা কেউ রিহ্যাবের সদস্য নয়। মূলত এক-দুই বিঘা জমি কিনে সাইনবোর্ড টানিয়ে কাগজ-কলমে প্লট বিক্রি করছে। আবার বিভিন্ন হোটেলে আবাসন মেলার নামে প্লট বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। রাজউকের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত