Ajker Patrika

‘জনবান্ধব’ বাজেটে আয় না থাকলেও কর

আবু তাহের খান
‘জনবান্ধব’ বাজেটে আয় না থাকলেও কর

সদ্য ঘোষিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে ‘সবার জন্য’ বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একই সুরে একে ‘জনবান্ধব’ বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, এটি হচ্ছে ‘গণমুখী ও গরিববান্ধব’ বাজেট। মোটকথা, তাঁদের ভাষায় এ হচ্ছে এমন এক গণমুখী বাজেট, যেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও প্রয়োজনকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

তো এবার সবার জন্য প্রণীত গণমুখী বাজেটের জনবান্ধব বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন, তা খানিকটা যাচাই করে দেখা যাক। প্রথমেই আসা যাক করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে। এ কেমন জনবান্ধব যে করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও একজন নিম্নবিত্ত নাগরিককে তাঁর সামর্থ্য ও প্রচলিত বিধানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রবঞ্চনামূলক সিদ্ধান্তের কারণে কর দিতেই হবে? ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সম্পূর্ণ নতুনভাবে উত্থাপিত এ কর-প্রস্তাব শুধু অযৌক্তিকই নয়, একই সঙ্গে তা করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণের বিদ্যমান ব্যবস্থা ও বিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ অবস্থায় যদি ধরেই নিতে হয় যে করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা আয়কর দেওয়ার প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বাজেট-বিলেও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তাহলে করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণের পদ্ধতিটি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এখন জনপ্রতিনিধিত্বের দাবিদার জাতীয় সংসদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা কোনটি করবেন—আয়বিহীন মানুষের ওপর দুই হাজার টাকা কর বসানোর অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব পাস করবেন, নাকি জননিপীড়নের এ শোষণমূলক প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে এ-সংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই থেকে যাবেন?

তথ্যমন্ত্রীর গরিববান্ধব বাজেটে একজন প্রায়-বিত্তহীন মানুষের করযোগ্য আয় না থাকলেও তাঁকে করদানে বাধ্য করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও স্বগোত্রীয় বিত্তবান কোটিপতিদের সারচার্জ প্রদানের ‘কষ্ট’ থেকে অধিক হারে উপশমদানের কথা কিন্তু অর্থমন্ত্রী একবারের জন্যও ভুলে যাননি। আর তা ভোলেননি বলেই আগে যেখানে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদধারীর জন্য সারচার্জ অব্যাহতির সুবিধা বহাল ছিল, সেখানে নতুন বাজেট প্রস্তাবে ওই সীমা বাড়িয়ে করা হয়েছে চার কোটি টাকা; অর্থাৎ চার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদধারীকে এখন থেকে আর কোনো সারচার্জ দিতে হবে না। তো এই না হলে উন্নয়ন! তবে মাননীয় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্থমন্ত্রী মহোদয় যে টাকাকড়ির গোনাগুনতির হিসাবে একেবারে নির্ভুল, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। চার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদধারীকে সারচার্জ মওকুফ সুবিধা দিতে যে পরিমাণ রাজস্ব তিনি হারাবেন, তার চেয়ে বেশি আদায় করে নেওয়ার জন্যই তিনি আরোপ করেছেন করযোগ্য আয় না থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে দুই হাজার টাকা করদানের নতুন সিদ্ধান্ত (আশা করা যায় অর্থমন্ত্রীর এ আপাতপ্রস্তাব জাতীয় সংসদ সদস্যদের মুহুর্মুহু অন্ধ করতালিতে সিদ্ধান্ত আকারেই পাস হবে)।

প্রশ্ন হচ্ছে, আয়বিহীন বা স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর এভাবে অন্যায্য পন্থায় কর আরোপের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কী? অধিকতর স্পষ্টীকরণের জন্য বিষয়টি সামনে আনা প্রয়োজন এ কারণে যে বাজেট অনুমোদন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলেও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এর পুরোটাই বস্তুত হয়ে থাকে আমলাতন্ত্রের হাত ধরে। ফলে এনবিআর অর্থমন্ত্রীর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এর একটি স্বতন্ত্র আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গির কথা চিন্তা করেই জানতে চাওয়া যে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কী? সামষ্টিক অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক তথ্য বলে, বাড়তি কর আদায়ের জন্য এনবিআর নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষের 
ওপর চড়াও হতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। কারণ নিম্নবিত্তের মানুষের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা ও শক্তি দুই-ই অত্যন্ত সামান্য। তা ছাড়া তাদের হাতের কাছে চট করে পাওয়াও যায় খুব সহজে।

অন্যদিকে বিত্তবানদের কাছ থেকে কর আদায়ে এনবিআরের নির্লিপ্ততা মূলত দুটি কারণে: এক. বিত্তবানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির কারণে তাদের ঘাঁটানোর সাহস ও ইচ্ছা কোনোটিই তাদের নেই। দুই. বিত্তবানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণে ঘাটতি হলেও তাতে ব্যক্তিগত লাভালাভের সুযোগ দুই পক্ষের জন্যই অবারিত। অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে বিত্তবানদের কর থেকে যতটা সম্ভব অব্যাহতি দিয়ে গরিবের ওপর সওয়ার হওয়ার নীতির বিষয়ে বর্তমান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দুই-ই প্রায় অভিন্ন; অর্থাৎ বাজেটে বিত্তবানদের আরও অধিক হারে ছাড় দিয়ে গরিবদের শোষণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যাপারে রাজনীতিক ও আমলা উভয় পক্ষের মধ্যেই এখন গভীর ঐকমত্য বিরাজ করছে। আর আমলা ও রাজনীতিকদের মধ্যকার এ ঐকমত্যের সূত্র ধরেই সমাজে নিপীড়ন ও বৈষম্য দুই-ই বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে মানুষের পিঠ ও দেয়ালের মধ্যে ফাঁকা জায়গা এখন আর এতটুকুও অবশিষ্ট নেই। 

বাজেটের আওতাধীন অন্য সব খাতেই মোটামুটি প্রায় একই অবস্থা। সর্বত্রই বিত্তবানের জয়জয়কার ও বিত্তহীনের করুণ গোঙানির শব্দ। নির্বাচনের বছর সামনে রেখে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই স্থানীয় ও বিদেশি অসৎ ঠিকাদার, চতুর আমলা, ধূর্ত বণিক ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের স্বার্থই রক্ষা পাচ্ছে সর্বাগ্রে এবং সর্বোচ্চ পরিসরে। সাধারণ মানুষ সেখানে উল্লিখিতদের স্বার্থ উদ্ধারের শিখণ্ডী মাত্র। অথচ সংবিধানের ৮৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংসদের কোনো আইনের দ্বারা বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাইবে না।’ কিন্তু বাজেটের আওতায় কার কর কমবে আর কারটা বাড়বে, সে বিষয়ে স্বার্থান্বেষী আমলা, বিত্তবান বণিক আর সুবিধাবাদী রাজনীতিকেরা মিলে যেসব সিদ্ধান্ত নেন এবং সংসদে গিয়ে যা মুহূর্তের করতালিতে অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে, তা কি সংবিধানের ওই চেতনার সঙ্গে যায়?

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত