বিভুরঞ্জন সরকার
বছরের শেষ দিকে এসে মনে হচ্ছিল এবার শীতটা রাজনৈতিক উত্তাপেই কাটবে। বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ ডেকে হঠাৎ চাঙা হয়ে উঠেছিল। ১০ ডিসেম্বর ঢাকা সমাবেশের আগে তারা বেশ জমিয়ে ফেলেছিল। সরকারের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে একের পর এক বিভাগীয় সমাবেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ করে সরকারের সামনে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার সক্ষমতা দেখিয়ে বেশ লম্বা সময় পর রাজনৈতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। বিএনপির পেছনে মানুষ নেই, তারা মুখে বড় বড় কথা বললেও বড় সমাবেশ করার ক্ষমতা নেই–এমন বিদ্রূপ তাদের শুনতে হয়েছে। অথচ বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো; বিশেষ করে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিলেও দলীয় সমর্থকদের সভাস্থলে উপস্থিত করার বিকল্প ব্যবস্থা করতে সফল হয়েছিল বিএনপি। কয়েকটি মহাসমাবেশে তো এক-দুদিন আগে থেকেই মানুষ উপস্থিত থেকে বিএনপির শক্তির জানান দিয়েছে।
বিভিন্ন সমাবেশে বড় জমায়েত দেখে বিএনপি নেতাদের কারও কারও সম্ভবত মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় এত বিশাল সমাবেশ হবে, যা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে, সরকারের পতন ত্বরান্বিত হবে। বিএনপি হয়তো সরকারের ভিত ও জনসমর্থনের দিকটি হালকাভাবেই দেখেছিল। আওয়ামী লীগ যে ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল নয়, কিংবা টোকাইদের দিয়ে গড়া দল নয়, এটা বিএনপির মাথা গরম নেতৃত্ব বিবেচনায় নিতে ভুলে গিয়ে এমন বক্তব্যও দিয়ে ফেলে, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। লন্ডনে ‘পালিয়ে থাকা’ দলের কান্ডারি তারেক রহমানের দেশে ফেরার কথাও বলা হয়। ব্যস, সরকার নড়েচড়ে বসে। ধরে নেওয়া হয়, বিএনপির কোনো বদমতলব আছে সরকার ফেলে দেওয়ার। সরকারি প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও সরকার কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বিএনপি।
ঢাকায় বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চাইলে সরকার আপত্তি জানায়। সরকার চেয়েছিল বিএনপির সমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিতে। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপি অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে হেরে গেছে। সমাবেশ নিতে হয়েছে গোলাপবাগে। গোলাপবাগের সমাবেশে লোকসমাগম কম হয়েছে, না বেশি হয়েছে, তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে এটা যে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পেরেছে সরকার তথা আওয়ামী লীগ। এটা বিএনপির পিছু হটা, আওয়ামী লীগের সাফল্য। এতে মানুষের কাছে এই বার্তা যায় যে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ইচ্ছামতোই চলতে হয়।
৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় এক বিএনপি কর্মী নিহত হওয়ার পর থেকেই বিএনপির অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। পুলিশ অভিযান চালায় বিএনপির অফিসে। প্রতিবাদে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা একা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ফুটপাতে কয়েক ঘণ্টা অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। দলের শত শত নেতা-কর্মীর কেউ সাহস করে তাঁর পাশে গিয়ে বসেননি। এর থেকেই বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার চিত্র ফুটে ওঠে। দলীয় অফিসে হামলা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের পর কোনো বড় ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করতেও পারেনি বিএনপি।
শীতকালে আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতির মাঠ গরম থাকে। আমাদের দেশে বড় সব আন্দোলন-সংগ্রাম শীতের আগে-পরেই হয়েছে। এ বছর সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেশি। শীতে মানুষ জবুথবু হয়ে আছে। রাজনীতির হাওয়াও গরম হতে না হতেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসেও বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের হাতে গরম কফির মগ তুলে না দিয়ে বরং সরকারকেই যেন কিছুটা স্বস্তি দিয়ে গেছেন। ফলে রাজনীতির মাঠ শিগগিরই গরম হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। উত্তাপ ছড়ানোর রাজনীতির দিন কি তাহলে শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব এখনই এককথায় দেওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, আয়-উপার্জনে ব্যাঘাত না ঘটে—মানুষ সেটাই চায়। তাই এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার আগে নেতা-নেত্রীদের মানুষের মনোভাবের কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-ধর্মঘট ইতিমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে।
‘খেলা হবে’ বলে রাজনীতিতে কয়েক দিন শোরগোল শোনা গেলেও এখন দৃশ্যত রাজনীতির ময়দানে খেলা দেখা যাচ্ছে না। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি হঠাৎ জেগে আবার ঝিমোচ্ছে। বিভাগীয় সমাবেশ করে দলটি যতটা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল, তা ধরে রাখার টনিক হিসেবে অসংখ্য নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা কতটুকু কার্যকর হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিসহ আরও অনেক দল চাইছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে। এ বিষয়টিও সীমিত আছে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের মধ্যে। জাতীয় রাজনীতি যেমন উত্তাপ ও গতিহীন, তৃণমূলের রাজনীতিও এখন চৈত্র মাসের শুকনো ডোবার মতো। সবাই যেন কিসের অপেক্ষায়, কোনো বাঁশির সুর বেজে ওঠে কি না, সে জন্য কান পেতে আছে। কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ কিছু করে না। আবার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগ জানে, যত দিন শেখ হাসিনা আছেন, তত দিন তাদের কোনো ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় দল ঢুকে গেছে সরকারে। আওয়ামী লীগের সরকার না হয়ে সরকারের আওয়ামী লীগ হয়েছে। ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই তদবির বা অন্য কোনো ধান্দায় ব্যস্ত। গত কয় বছরে তৃণমূলের অনেকেই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কে কীভাবে টাকা কামিয়েছেন, কান পাতলেই তা শোনা যায়। এসব শুধুই কি রটনা?
সারা দেশে আওয়ামী লীগের এখনকার রাজনীতি হলো আখের গোছানোর। পাওয়া এবং খাওয়ার রাজনীতি। কিন্তু সবাই তো আর খেতে-পরতে পারছেন না। তাই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। পাওয়া গ্রুপ এবং না-পাওয়া গ্রুপের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে কেন্দ্র থেকে হুকুম দিয়েও এটা দূর করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তৃণমূলে বিএনপির অবস্থাও ভালো নয়। বিএনপির সমর্থকদেরও ভরসার জায়গা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। দুজনই দণ্ডিত আসামি।একজন সরকারের অনুগ্রহে গৃহবন্দী, অন্যজন লন্ডনে বসে স্কাইপে দল চালান। ফলে তৃণমূলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও অস্থিরতা আছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে তারপরও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিএনপির কেন্দ্রের মতো স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এতটাই মশগুল যে তাঁরা সংগঠনকে মজবুত করার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াজ করতে। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে যেতে পারবেন, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিএনপিতেও চরম।
দেখা যায় এটাই যে এলাকা এলাকায় দল আছে, আছে দলাদলিও। কেউ বলতে পারেন, এটাই তো রাজনীতি। দল এবং দলাদলি থাকলেই বুঝতে হবে রাজনীতি আছে। হ্যাঁ, এই অর্থে তৃণমূলে রাজনীতি আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আছে সব জায়গায়। জাতীয় পার্টি আর জামায়াত আছে অনেক জায়গায়। আর অন্য সব দল আছে কোনো কোনো জায়গায়। বাম দলগুলোর অবস্থান তৃণমূলে একেবারেই দুর্বল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুধু যে দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে তা নয়, বাড়ি বাড়িতে আছে। আমি এটাও কোথাও কোথাও লক্ষ করেছি যে এক পরিবারে চার রাজনৈতিক দলের সদস্যও আছেন—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাসদ।
জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব সদ্ভাব না থাকলেও তৃণমূলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রেষারেষি নেই, সেটা বলা যাবে না, তবে একধরনের গোপন সমঝোতাও আছে। আওয়ামী লীগের এ রকম সমঝোতা আছে কোথাও কোথাও জামায়াতের সঙ্গেও। এই মিলমিশের পেছনে আবার লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলেও শোনা যায়। সরকারি দলের লোকেরা দুই পয়সা আয়-রোজগার করছেন, বিএনপি-জামায়াত তাদের সহযোগিতা করছে। এমনও শোনা যায় যে এই মর্মে গোপন সমঝোতা হচ্ছে, এখন বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, পরে দরকার হলে আওয়ামী লীগও যেন সেটা পায়; অর্থাৎ তৃণমূলের রাজনীতিও আর নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির রাজনীতি অবশ্য জাতীয় পর্যায়েও নেই।
একটা সময় ছিল যখন রাজনীতির গতিমুখ ছিল তৃণমূলে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের জন্য কাজ করে তৃণমূলে যাঁরা জনগণের বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠতেন, তাঁরাই ধাপে ধাপে জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই পেতেন। এখন ধারা বদলে গেছে। এখন নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন হয় না। এখনকার বেশির ভাগই হাইব্রিড নেতা। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতি এখন বিত্তবান হওয়ার উপায়।রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা। জাতীয় রাজনীতির এই ধাক্কা তৃণমূলেও আঘাত হেনেছে। তাই তৃণমূলেও চলছে টাকার খেলা। স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনেও এখন যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়, তা এক কথায় অকল্পনীয়।
তৃণমূলের রাজনীতিতে সবার অলক্ষ্যে একটি পরিবর্তন ঘটছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতার সুযোগে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করছে। জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে কৌশলী ও সুচতুর রাজনৈতিক দল। তাদের বেড়ে ওঠার ভয়াবহ বিপদ আজ যাঁরা দেখছেন না, তাঁরা খুব শিগগির পস্তাবেন। জামায়াতের সঙ্গে আজ যাঁরা কৌশলের খেলা খেলছেন, তাঁরা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন হয়তো আর সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে না।
তৃণমূলের রাজনীতির ক্ষয়রোগ নিরাময় করতে হলে জাতীয় রাজনীতিতেই আগে পরিবর্তন আনতে হবে। তৃণমূলের ওপর ভর করে জাতীয় রাজনীতি, নাকি জাতীয় রাজনীতির ধারায় তৃণমূলের রাজনীতি–এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বছরের শেষ দিকে এসে মনে হচ্ছিল এবার শীতটা রাজনৈতিক উত্তাপেই কাটবে। বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ ডেকে হঠাৎ চাঙা হয়ে উঠেছিল। ১০ ডিসেম্বর ঢাকা সমাবেশের আগে তারা বেশ জমিয়ে ফেলেছিল। সরকারের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে একের পর এক বিভাগীয় সমাবেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ করে সরকারের সামনে কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার সক্ষমতা দেখিয়ে বেশ লম্বা সময় পর রাজনৈতিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। বিএনপির পেছনে মানুষ নেই, তারা মুখে বড় বড় কথা বললেও বড় সমাবেশ করার ক্ষমতা নেই–এমন বিদ্রূপ তাদের শুনতে হয়েছে। অথচ বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো; বিশেষ করে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিলেও দলীয় সমর্থকদের সভাস্থলে উপস্থিত করার বিকল্প ব্যবস্থা করতে সফল হয়েছিল বিএনপি। কয়েকটি মহাসমাবেশে তো এক-দুদিন আগে থেকেই মানুষ উপস্থিত থেকে বিএনপির শক্তির জানান দিয়েছে।
বিভিন্ন সমাবেশে বড় জমায়েত দেখে বিএনপি নেতাদের কারও কারও সম্ভবত মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় এত বিশাল সমাবেশ হবে, যা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে, সরকারের পতন ত্বরান্বিত হবে। বিএনপি হয়তো সরকারের ভিত ও জনসমর্থনের দিকটি হালকাভাবেই দেখেছিল। আওয়ামী লীগ যে ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল নয়, কিংবা টোকাইদের দিয়ে গড়া দল নয়, এটা বিএনপির মাথা গরম নেতৃত্ব বিবেচনায় নিতে ভুলে গিয়ে এমন বক্তব্যও দিয়ে ফেলে, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। লন্ডনে ‘পালিয়ে থাকা’ দলের কান্ডারি তারেক রহমানের দেশে ফেরার কথাও বলা হয়। ব্যস, সরকার নড়েচড়ে বসে। ধরে নেওয়া হয়, বিএনপির কোনো বদমতলব আছে সরকার ফেলে দেওয়ার। সরকারি প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও সরকার কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বিএনপি।
ঢাকায় বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চাইলে সরকার আপত্তি জানায়। সরকার চেয়েছিল বিএনপির সমাবেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিতে। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপি অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে হেরে গেছে। সমাবেশ নিতে হয়েছে গোলাপবাগে। গোলাপবাগের সমাবেশে লোকসমাগম কম হয়েছে, না বেশি হয়েছে, তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে এটা যে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পেরেছে সরকার তথা আওয়ামী লীগ। এটা বিএনপির পিছু হটা, আওয়ামী লীগের সাফল্য। এতে মানুষের কাছে এই বার্তা যায় যে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ইচ্ছামতোই চলতে হয়।
৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় এক বিএনপি কর্মী নিহত হওয়ার পর থেকেই বিএনপির অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। পুলিশ অভিযান চালায় বিএনপির অফিসে। প্রতিবাদে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা একা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ফুটপাতে কয়েক ঘণ্টা অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। দলের শত শত নেতা-কর্মীর কেউ সাহস করে তাঁর পাশে গিয়ে বসেননি। এর থেকেই বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার চিত্র ফুটে ওঠে। দলীয় অফিসে হামলা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের পর কোনো বড় ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করতেও পারেনি বিএনপি।
শীতকালে আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতির মাঠ গরম থাকে। আমাদের দেশে বড় সব আন্দোলন-সংগ্রাম শীতের আগে-পরেই হয়েছে। এ বছর সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেশি। শীতে মানুষ জবুথবু হয়ে আছে। রাজনীতির হাওয়াও গরম হতে না হতেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে এসেও বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের হাতে গরম কফির মগ তুলে না দিয়ে বরং সরকারকেই যেন কিছুটা স্বস্তি দিয়ে গেছেন। ফলে রাজনীতির মাঠ শিগগিরই গরম হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। উত্তাপ ছড়ানোর রাজনীতির দিন কি তাহলে শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব এখনই এককথায় দেওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, আয়-উপার্জনে ব্যাঘাত না ঘটে—মানুষ সেটাই চায়। তাই এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার আগে নেতা-নেত্রীদের মানুষের মনোভাবের কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-ধর্মঘট ইতিমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে।
‘খেলা হবে’ বলে রাজনীতিতে কয়েক দিন শোরগোল শোনা গেলেও এখন দৃশ্যত রাজনীতির ময়দানে খেলা দেখা যাচ্ছে না। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি হঠাৎ জেগে আবার ঝিমোচ্ছে। বিভাগীয় সমাবেশ করে দলটি যতটা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল, তা ধরে রাখার টনিক হিসেবে অসংখ্য নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা কতটুকু কার্যকর হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিসহ আরও অনেক দল চাইছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে। এ বিষয়টিও সীমিত আছে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের মধ্যে। জাতীয় রাজনীতি যেমন উত্তাপ ও গতিহীন, তৃণমূলের রাজনীতিও এখন চৈত্র মাসের শুকনো ডোবার মতো। সবাই যেন কিসের অপেক্ষায়, কোনো বাঁশির সুর বেজে ওঠে কি না, সে জন্য কান পেতে আছে। কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ কিছু করে না। আবার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগ জানে, যত দিন শেখ হাসিনা আছেন, তত দিন তাদের কোনো ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় দল ঢুকে গেছে সরকারে। আওয়ামী লীগের সরকার না হয়ে সরকারের আওয়ামী লীগ হয়েছে। ছোট-বড় প্রায় সব নেতাই তদবির বা অন্য কোনো ধান্দায় ব্যস্ত। গত কয় বছরে তৃণমূলের অনেকেই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কে কীভাবে টাকা কামিয়েছেন, কান পাতলেই তা শোনা যায়। এসব শুধুই কি রটনা?
সারা দেশে আওয়ামী লীগের এখনকার রাজনীতি হলো আখের গোছানোর। পাওয়া এবং খাওয়ার রাজনীতি। কিন্তু সবাই তো আর খেতে-পরতে পারছেন না। তাই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। পাওয়া গ্রুপ এবং না-পাওয়া গ্রুপের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে কেন্দ্র থেকে হুকুম দিয়েও এটা দূর করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
তৃণমূলে বিএনপির অবস্থাও ভালো নয়। বিএনপির সমর্থকদেরও ভরসার জায়গা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। দুজনই দণ্ডিত আসামি।একজন সরকারের অনুগ্রহে গৃহবন্দী, অন্যজন লন্ডনে বসে স্কাইপে দল চালান। ফলে তৃণমূলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও অস্থিরতা আছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে তারপরও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিএনপির কেন্দ্রের মতো স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এতটাই মশগুল যে তাঁরা সংগঠনকে মজবুত করার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াজ করতে। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে যেতে পারবেন, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিএনপিতেও চরম।
দেখা যায় এটাই যে এলাকা এলাকায় দল আছে, আছে দলাদলিও। কেউ বলতে পারেন, এটাই তো রাজনীতি। দল এবং দলাদলি থাকলেই বুঝতে হবে রাজনীতি আছে। হ্যাঁ, এই অর্থে তৃণমূলে রাজনীতি আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আছে সব জায়গায়। জাতীয় পার্টি আর জামায়াত আছে অনেক জায়গায়। আর অন্য সব দল আছে কোনো কোনো জায়গায়। বাম দলগুলোর অবস্থান তৃণমূলে একেবারেই দুর্বল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুধু যে দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে তা নয়, বাড়ি বাড়িতে আছে। আমি এটাও কোথাও কোথাও লক্ষ করেছি যে এক পরিবারে চার রাজনৈতিক দলের সদস্যও আছেন—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাসদ।
জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব সদ্ভাব না থাকলেও তৃণমূলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রেষারেষি নেই, সেটা বলা যাবে না, তবে একধরনের গোপন সমঝোতাও আছে। আওয়ামী লীগের এ রকম সমঝোতা আছে কোথাও কোথাও জামায়াতের সঙ্গেও। এই মিলমিশের পেছনে আবার লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলেও শোনা যায়। সরকারি দলের লোকেরা দুই পয়সা আয়-রোজগার করছেন, বিএনপি-জামায়াত তাদের সহযোগিতা করছে। এমনও শোনা যায় যে এই মর্মে গোপন সমঝোতা হচ্ছে, এখন বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, পরে দরকার হলে আওয়ামী লীগও যেন সেটা পায়; অর্থাৎ তৃণমূলের রাজনীতিও আর নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির রাজনীতি অবশ্য জাতীয় পর্যায়েও নেই।
একটা সময় ছিল যখন রাজনীতির গতিমুখ ছিল তৃণমূলে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের জন্য কাজ করে তৃণমূলে যাঁরা জনগণের বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠতেন, তাঁরাই ধাপে ধাপে জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই পেতেন। এখন ধারা বদলে গেছে। এখন নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন হয় না। এখনকার বেশির ভাগই হাইব্রিড নেতা। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতি এখন বিত্তবান হওয়ার উপায়।রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা। জাতীয় রাজনীতির এই ধাক্কা তৃণমূলেও আঘাত হেনেছে। তাই তৃণমূলেও চলছে টাকার খেলা। স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনেও এখন যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয়, তা এক কথায় অকল্পনীয়।
তৃণমূলের রাজনীতিতে সবার অলক্ষ্যে একটি পরিবর্তন ঘটছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতার সুযোগে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করছে। জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে কৌশলী ও সুচতুর রাজনৈতিক দল। তাদের বেড়ে ওঠার ভয়াবহ বিপদ আজ যাঁরা দেখছেন না, তাঁরা খুব শিগগির পস্তাবেন। জামায়াতের সঙ্গে আজ যাঁরা কৌশলের খেলা খেলছেন, তাঁরা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন হয়তো আর সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে না।
তৃণমূলের রাজনীতির ক্ষয়রোগ নিরাময় করতে হলে জাতীয় রাজনীতিতেই আগে পরিবর্তন আনতে হবে। তৃণমূলের ওপর ভর করে জাতীয় রাজনীতি, নাকি জাতীয় রাজনীতির ধারায় তৃণমূলের রাজনীতি–এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৭ দিন আগেগাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪দেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২০ নভেম্বর ২০২৪