Ajker Patrika

লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের ফাঁদে দেশের পুঁজিবাজার

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের ফাঁদে দেশের পুঁজিবাজার

দুর্বল, অচল ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের ফাঁদে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। কিছু কোম্পানি আছে উৎপাদন সীমিত কিংবা একেবারেই উৎপাদনে নেই, অথচ শেয়ারদর বেশ চাঙা। আবার লোকসানে ব্যবসায় টিকে থাকা অনিশ্চিত এমন কোম্পানিও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শেয়ারবাজারে। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক এবং পুঁজিবাজারের জন্য শুভ নয় বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

উৎপাদন ও ব্যবসায়ে দুর্বল, অথচ পুঁজিবাজারে শক্তিশালী—এমন ১০টি কোম্পানির হালনাগাদ নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং লেনদেন পর্যালোচনা করেছে আজকের পত্রিকা। এতে দেখা যায়, কোনোটির উৎপাদন নেই, কোনোটির কার্যক্রম সীমিত, আবার কোনোটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাজারে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে শেয়ারের দাম। কোম্পানিগুলো হলো জুট স্পিনার্স, লিগ্যাসি ফুটওয়ার, জিলবাংলা, শ্যামপুর সুগার মিল, আজিজ পাইপস, দেশ গার্মেন্টস, এটলাস বাংলাদেশ, সমতা লেদার, উসমানিয়া গ্লাস ও ইস্টার্ন কেব্‌লস।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ছে আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভের আসায় মরীচিকার পেছনে ছুটে নিজের বিনিয়োগকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। মূলত কারসাজি আর সিন্ডিকেটের কারণে এসব শেয়ারের দর বাড়ে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তদন্ত করে এ ধরনের কোম্পানির লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, লোকসানি কোম্পানির দাম বাড়ে, এটা জুয়া খেলা। জুয়াড়িরা সিন্ডিকেট ট্রেডিং করে। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়ী করে তিনি বলেন, অকারণ মূল্যবৃদ্ধি বিএসইসি ঠেকাতে পারত। ওদের ট্রেডিং সাসপেন্ড করা উচিত; কিন্তু করা হচ্ছে না।

লোকসান ও বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের পরেও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি দেখা গেছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ারের। ১২ কর্মদিবসে ৪৯ টাকা ৯০ পয়সা বা ১১৮ শতাংশ বেড়ে গত সোমবার কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৯২ টাকা ৪০ পয়সা।

অথচ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের মোট নগদ তহবিল ছিল মাত্র ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া কোম্পানিটি আইন ভঙ্গ করে সব লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে নগদে করেছে। এ ক্ষেত্রে উৎসে কর কাটা হয়নি। এ জন্য ভবিষ্যতে অতিরিক্ত কর দায়ের ঝুঁকিতে প্রতিষ্ঠানটি। বিএসইসির নির্দেশনা মেনে অবণ্টিত লভ্যাংশও হস্তান্তর করেনি লিগ্যাসি ফুটওয়্যার।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের কোম্পানি সচিব আব্দুল বাতেন ভূঁইয়ার সঙ্গে। কিন্তু ফোন ধরে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি জানালেন, তিনি ওই কোম্পানির কেউ নন।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক লোকসানি কোম্পানি জুট স্পিনার্স। লোকসানের কারণে এখন ব্যবসায় টিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। অথচ কোম্পানির শেয়ারদর এখন ২৩৮ টাকার ওপরে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে জুট স্পিনার্স।

এর পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকায়। চলতি হিসাবে দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির মোট সম্পত্তির তুলনায় ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেশি। অর্থাৎ কোম্পানিটির পক্ষে বর্তমানে দায় মেটানোর কোনো সক্ষমতা নেই। কোম্পানিটির কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ৪৮ কোটি টাকা। টাকা ফেরত পেতে আইনি লড়াই শুরু করেছে ব্যাংকটি।

এ নিয়ে জানতে চাইলে জুট স্পিনার্সের কোম্পানি সচিব এ টি এম মোস্তফা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। যা আছে, রিপোর্টেই আছে।’

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি সমতা লেদার। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, কোম্পানিটির আর্থিক হিসাবে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার মজুত পণ্য দেখিয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে পরিদর্শনে কোনো আইটেমভিত্তিক তালিকা ও পণ্যমূল্য পাওয়া যায়নি। গায়েবি মজুত পণ্য দেখিয়েছে কোম্পানিটি। এর বাইরেও কোম্পানি পরিচালনায় কোনো নিয়মনীতি মানেনি সমতা লেদার। তারপরও এর শেয়ারদর বাড়ছে। গত ২২ মার্চ কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ৫৩ টাকা ৭০ পয়সায়। পরে ৭ কর্মদিবসে ২৩ টাকার বেশি বেড়ে গত সোমবার এর দর ৭৭ টাকায় পৌঁছে যায়।

দেশের তৈরি পোশাক খাতের পথিকৃৎ বলা হয় দেশ গার্মেন্টসকে। রপ্তানিতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করলেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা এখন তলানিতে। সেই সঙ্গে আইনভঙ্গ ও আর্থিক প্রতিবেদনে অসংগতির তথ্য উঠে এসেছে কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে। তাতে দেখা যায়, শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড। কোম্পানির ব্যাংক হিসাব ও পরিচালকদের দেওয়া ঋণের ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ নথি পায়নি নিরীক্ষক। এ ছাড়া ৩৩ বছর ধরে অবণ্টিত লভ্যাংশও বিতরণ করেনি কোম্পানি। ডিএসইর তথ্য বলছে, গত ৫ বছরের ব্যবধানে দেশ গার্মেন্টসের আয় কমেছে ৯৯ শতাংশ। অথচ শেয়ারের দর বেড়ে গত বৃহস্পতিবার ১১৯ টাকা ৯০ পয়সায় ঠেকেছে।

কোম্পানি সচিব ড. কে মৌলিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হলেও অডিটররা ধরে।’ অবণ্টিত লভ্যাংশ না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি চালাতে গেলে অনেক খরচ। দিচ্ছি না এমন নয়। দিতে পারিনি, দেব।’

শেয়ার দরে বেশ ভালো অবস্থানে আছে এটলাস বাংলাদেশ। ডিএসইতে প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ শেয়ার দর ১০৪ টাকা ২০ পয়সায় উঠতে দেখা গেছে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাত বছরে এটলাস বাংলাদেশের পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৯ টাকা। প্রতিবেদনে কোম্পানিটির ব্যবসায়িক ঝুঁকির বিষয়টিও উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, লোকসানে নিমজ্জিত এটলাস বাংলাদেশের মূল ফাইন্যান্সিয়াল বিষয়গুলো খারাপ অবস্থায় চলে গেছে।

ব্যবসার হাল সম্পর্কে জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হিরো হোন্ডা চলে যাওয়ার পর লোকসান শুরু হয়। জংশেনের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু বাইক বিক্রি না হওয়ায় আর আমদানি করা হয়নি। ঘুরে দাঁড়াতে ইলেকট্রিক বাইক উৎপাদন এবং সে বিষয়ে চুক্তির প্রক্রিয়া চলমান।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি জিলবাংলা সুগার মিল। গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার দর ১২৭ টাকা ৪০ পয়সায় ঠেকেছে। যদিও নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে জিলবাংলা সুগার মিলের পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫৫৮ কোটি ৬৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৬ টাকা। এর বিপরীতে ওই সময়ে কোম্পানির দায় ৫৪৩ কোটি ৪২ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৯ টাকা ছাড়িয়েছে।

এ বিষয়ে কোম্পানি সচিব নাজমুল হুদা বলেন, বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা করতে আইসিবিকে কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে। আর দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। আস্তে আস্তে ভালো হবে।’

দেশের শিল্প খাতের অন্যতম পুরোনো প্রতিষ্ঠান উসমানিয়া গ্লাস শিট কারখানা লিমিটেড। পুঁজিবাজারে জেড ক্যাটাগরিতে লেনদেন করছে উসমানিয়া গ্লাস। ডিএসইর ওয়েবসাইট থেকে ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে লোকসানে রয়েছে কোম্পানি। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭ টাকা ২১ পয়সা পর্যন্ত লোকসান করেছে। গত বৃহস্পতিবার শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৫৯ টাকা ৬০ পয়সায়। 

আরও যেসব লোকসানি কোম্পানি 
টানা লোকসানে থাকা শ্যামপুর সুগার মিলের শেয়ারদর মার্চের শুরুতে ৬৩ টাকা ১০ পয়সা ছিল। ২৩ দিনে ৩০ টাকার মতো বেড়ে ২৩ মার্চ তা ৯৬ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায়। এরপর চার দিন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় নেমেছে দর। শ্যামপুর সুগার মিলের কোম্পানি সচিব কায়েস খান বলেন, সম্প্রতি শেয়ারদর বেড়েছে। এটা লোকসানের কারণে আপাতত কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এটা নিয়ে হয়তো অন্যভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। 
২০২২ সালে ৪ টাকা ৫৪ পয়সা লোকসান দেওয়া আজিজ পাইপসের দর বাড়ছে ২২ মার্চ থেকে। ধারাবাহিক দর বেড়ে ১০২ টাকা ১০ পয়সায় যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার ৫ টাকা ৯০ পয়সা কমে শেয়ারদর নেমেছে ৯৬ টাকা ৯০ পয়সায়।

আজিজ পাইপসের কোম্পানি সচিব এ এইচ এম জাকারিয়াকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। আগের চার বছর বড় লোকসান দেওয়ার পর ২০২২ সালে শেয়ারপ্রতি কেবল ৩৪ পয়সা আয় করতে পেরেছে ইস্টার্ন ক্যাবলস। বিভিন্ন সময় কারসাজিতে এর শেয়ারদরে ব্যাপক উত্থান-পতন দেখা যায়। গত সোমবার ১৮১ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি তিন দিনে বেড়ে হয়েছে ১৯১ টাকা ৫০ পয়সা।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া ইস্টার্ন কেবলসের নম্বরে কল করলে কোম্পানি সচিব গোলাম মওলা জানান, তিনি এখন আর সেখানে নেই। লোকসানি কোম্পানির পুঁজিবাজারে ভালো অবস্থানে থাকা প্রসঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসব জায়গায় কারসাজি হচ্ছে বা আশঙ্কা মনে হচ্ছে, সেসব জায়গায় আরও তদন্ত হওয়া উচিত।’ কৃত্রিমভাবে সূচক ঠেকিয়ে রাখা ও পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থা কারসাজির প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘প্র্যাকটিক্যালি স্টক মার্কেট বন্ধ প্রায়। কয়েকটা ছোটখাটো কোম্পানি নাড়াচাড়া হচ্ছে মাত্র। এই পরিস্থিতিতে কারসাজি হবে, সেটাই স্বাভাবিক।’

এসব বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত নন-কমপ্লায়েন্স, লো ফান্ডামেন্টালের পরেও যাঁরা কিনছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, কেন কিনছেন? তবে কোনো ম্যানুপুলেটিভ অ্যাটেম্পট পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বাইরে রেগুলেটর হিসেবে বেশি কিছু করার নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত