Ajker Patrika

শিক্ষক না হয়েও বেতন!

 টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭: ১৭
Thumbnail image

নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০১৪ সালে। প্রতি মাসে তাঁর বিলও আসছে; কিন্তু স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা তাঁকে চেনেন না। তবু এমপিওভুক্ত হয়েছেন শিক্ষিকা। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে অস্তিত্বহীন ওই শিক্ষিকার পরিবর্তে প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালীর স্ত্রী সাধনা রানী বিশ্বাসের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী টুঙ্গিপাড়া উপজেলার নবুখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

এমন ঘটনা ঘটেছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় উপজেলার ত্রিপল্লী শেখ আবু নাসের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর অস্তিত্বহীন শিক্ষিকাকে নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অস্তিত্বহীন ওই শিক্ষিকার নাম সুতৃষ্ণা বর। ওই স্কুলের বাংলার সাবেক শিক্ষক উৎপলা বিশ্বাসের যোগদানের তারিখকে সুতৃষ্ণা বরের নিয়োগের তারিখ দেখানো হয়েছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার শ্রীরামকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগের বরাত দিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ওই প্রধান শিক্ষক এককভাবে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, সদস্য ও শিক্ষকদের অগোচরে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগ-বাণিজ্য ও দুর্নীতি করে আসছেন। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গণিত ও বাংলা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের দুটি বিজ্ঞপ্তি দেন। ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী শিক্ষক বাংলা বিষয়ে উৎপলা বিশ্বাস ও গণিত বিষয়ে সুশান্ত মালাকার নিয়োগ পান। উৎপলা বিশ্বাস ২০১৪ সালের ৩ মে থেকে ২০১৬ সালের ৬ জুন পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক বাংলা বিষয়ে নিয়মিত পাঠদান করান। পরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উৎপলা বিশ্বাসের চাকরি হয়। ২০১৬ সালের ৭ জুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি।

জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, ‘২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কোনো সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল না। কারণ ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব সহকারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এনটিআরসি নিয়ে নেয়। উৎপলা বিশ্বাস অব্যাহতি নেওয়ার পর প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি অবৈধভাবে নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি, পরীক্ষা ও রেজল্যুশন ছাড়াই ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে সুতৃষ্ণা বর নামের এক মহিলাকে বাংলা বিষয়ে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত, বিল ছাড়করণ করতে প্রধান শিক্ষক মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেছি।’

ত্রিপল্লী শেখ আবু নাছের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক সুশান্ত মালাকার বলেন, ‘২০১৪ সালে আমার ও উৎপলা বিশ্বাসের নিয়োগ হয়। উৎপলা বিশ্বাস ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলা বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করান; কিন্তু সুতৃষ্ণা বর নামের কোনো শিক্ষিকাকে আজ পর্যন্ত স্কুলে আসতে দেখিনি। তবু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তাঁর বিল আসছে।’

ওই বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক রুমা খানম বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে আমার নিয়োগের পর থেকে সুতৃষ্ণা বর নামের কোনো শিক্ষিকাকে বিদ্যালয়ে পাঠদান করাতে দেখিনি। ওই নামের কোনো শিক্ষিকাকে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও চেনে না। তিনি কীভাবে নিয়োগ পেলেন সেটিই প্রশ্ন!’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি শুধু সুতৃষ্ণা বরই নন, অনেক শিক্ষককে নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নৈশপ্রহরীর বিল করতে, মাধ্যমিক স্বীকৃতি, এমপিওকরণ, অডিট বাবদ আমাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া করোনাকালে ঢাকা যাতায়াত বাবদ বিদ্যালয়ের তহবিল থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রধান শিক্ষক নিজের খেয়ালখুশিমতো বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন। ডিজিটাল হাজিরা অন্যান্য বিদ্যালয়ে চালু করা হলেও প্রধান শিক্ষকের জন্য এখানে চালু হয়নি। শিক্ষকদের হাজিরা খাতা প্রধান শিক্ষকের জিম্মায় তাঁর কক্ষে তালাবদ্ধ থাকে।

ওই বিদ্যালয়ের সাবেক বাংলা বিষয়ের শিক্ষকাউৎপলা বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ওই বিদ্যালয়ে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। তারপর আমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয়। তখন থেকে আমি টুঙ্গিপাড়ার ডুমরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করে আসছি।’

এ বিষয়ে ত্রিপল্লী শেখ আবু নাছের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি ঢালী বলেন, ভুলবশত সুতৃষ্ণার জায়গায় স্কুলের ওয়েবসাইটে আমার স্ত্রীর ছবি দেওয়া হয়েছে। এর আগে বিষয়টি নিয়ে আমি এক ডজন সাংবাদিক ফেস করেছি। আপনারা যা পারেন করেন, তাতে আমার কিছুই হবে না বলেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল মামুন বলেন, প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির বিষয়টি আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে জানতে পারলাম। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত