Ajker Patrika

তাৎপর্যময় ২০ ফেব্রুয়ারি

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
তাৎপর্যময় ২০ ফেব্রুয়ারি

১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, এর কার্যক্রম ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্‌যাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে বক্তারা আলোচনা করেন এবং এই কমিটি পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কমিটি গঠিত হওয়ার কয়েক দিন পর তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পতাকা দিবস উদ্‌যাপন করা হয় এবং গণপরিষদের সদস্যদের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। হাবিবুর রহমান শেলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে এই খসড়া গৃহীত হয় ২৫ মার্চ। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্মারকলিপিটি মুদ্রণের পর তা পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের কাছে এবং পাকিস্তানের সব পত্রিকায় পাঠানো হয়।

লিয়াকত আলি খান রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা দেন। সেখানে নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার ভাষা কী হবে, সেটা পূর্ব বাংলার জনগণই নির্ধারণ করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’

২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিবাদ হয়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রতীকী ধর্মঘট ও সভা আহ্বান করে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেয়ে যায় পোস্টারে পোস্টারে। ১৯৪৮ সালে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের যে চুক্তি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের দাবি জানান তাঁরা। সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। একটি মিছিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে।

৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কাজী গোলাম মাহবুব একটি সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন যোগদান করে। সভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন ময়দানের বক্তৃতার রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ করা হয় এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়। বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের সরকারি চক্রান্তের বিরোধিতা বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের পর ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সমবেত হলে সেখানে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা পরিষদের পরবর্তী অধিবেশন শুরু হওয়ার সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই দিনটি লক্ষ্য করে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা পূর্ব বাংলায় এক সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সভা শেষ হলে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবন, হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নবাবপুর, পাটুয়াটুলী, আরমানিটোলা, নাজিমুদ্দিন রোড অতিক্রম করে আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে আসে। শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে যশোর, নোয়াখালী ও রাজশাহীতেও শোভাযাত্রা হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করেন। তখন আন্দোলনকারীদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটিই এসে দাঁড়াল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না। সেদিনই বেলা ৩টায় শুরু হয়েছিল পরিষদের সভা। ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ ও ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদে’র কর্মসূচিতে পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের কথা ছিল। কিন্তু তাতে এমন কোনো ঘোষণা ছিল না, যাতে জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের ৯৪ নবাবপুর রোডের অফিসে খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে বিকেল ৫টায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়। ভোটাভুটিতে দেখা গেল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ভোট পড়েছে ১১ জনের, ভঙ্গ করার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪ জনের। যুক্তিতর্কের পর ঠিক হলো, ১৪৪ ধারা ভাঙা ও না ভাঙার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হবে পরদিনের ছাত্রসভায়। ছাত্ররাই সিদ্ধান্ত নেবেন।

এরপর এল একুশে ফেব্রুয়ারি। সে কথাই বলা হবে। তবে বলে রাখা ভালো, শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। ফলে, গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আমতলার সভাটি আসলে বারুদে আগুন দিয়েছে শুধু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র

প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর যা বলল ইইউ

আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না, বিস্ফোরক তামিম

কাগজে-কলমে মেয়র হওয়ায় দায়িত্ব পালন করলাম: জাতীয় ঈদগাহ পরিদর্শন শেষে ইশরাক

এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত