Ajker Patrika

খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ইসলাম

ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১০: ২৪
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ইসলাম

আল্লাহ তাআলা মানবজাতির খাওয়ার জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, তা-ই খাদ্য। বিভিন্ন অখাদ্য ও নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণকে খাদ্যে ভেজাল বলে অভিহিত করা হয়। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ মানেই ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে মহা অপরাধ। অধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রকমারি রং, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইউরিয়াসহ প্রভৃতি বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। ইসলাম এটি কখনোই সমর্থন করে না। কেননা, এসব কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যা মরণব্যাধি ক্যানসারসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে। এটি অনৈতিক ও অমানবিক কাজ হওয়ায় ইসলামে তা চরমভাবে নিন্দনীয়। এ অপরাধ করার মাধ্যমে ব্যক্তি যেমন প্রতারণা, ধোঁকা, অর্থ আত্মসাৎ ও মিথ্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তেমনি খাদ্যকে অখাদ্যে পরিণত করে, মানুষকে কষ্ট দেয় এবং শারীরিকভাবে ক্ষতি করে। তাই ইসলাম খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

প্রতারণা ও ধোঁকা নিষিদ্ধকরণ
খাদ্যে ভেজাল মেশানো ধোঁকা ও প্রতারণার শামিল। এটি ইসলামে নিষিদ্ধ। যারা প্রতারণা করে তারা যেমন সমাজে নিন্দনীয়, তেমনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছেও অপছন্দনীয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একদা মহানবী (সা.) বাজারে একটি খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলে তাতে ভেজা পেলেন। তিনি বিক্রেতার কাছে ভেজা হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। সে বলল, “হে আল্লাহর রাসুল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।” জবাবে তিনি বললেন, “তাহলে তুমি ভেজা খাদ্যগুলো স্তূপের ওপরে কেন রাখলে না, যাতে মানুষ দেখতে পায়?” অতঃপর তিনি বললেন, “যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।”’ (মুসলিম)

মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ ওজনে কম দেয় এবং ভেজাল মিশ্রিত করে, তখন তারা দুর্ভিক্ষ, জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও ক্ষমতাশীলদের অত্যাচারের শিকার হয়।’ (ইবন মাজাহ)

অবৈধ উপার্জন নিষিদ্ধকরণ
ইসলাম সর্বদা বৈধ উপার্জনের নির্দেশ দেয়। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণের ফলে অতিরিক্ত যে মুনাফা আসে তা অবৈধ। এটি ভক্ষণ করা হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)

আল্লাহ আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা: ২৯)

সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ নিষিদ্ধকরণ
খাদ্যে ভেজাল মেশানো সত্য-মিথ্যার মিশ্রণের শামিল। তাই ইসলাম তা কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্যকে গোপন করো না।’ (সুরা বাকারা: ৪২)

একদা মহানবী (সা.) জিজ্ঞাসিত হলেন, ‘একজন মুমিন কি ভীরু হওয়া স্বাভাবিক?’ তিনি বললেন, ‘স্বাভাবিক।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘একজন মুমিন কি কৃপণ হতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘একজন মুমিন কি মিথ্যুক হতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘না।’ (মিশকাত)

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তিন শ্রেণির মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের মধ্যে একটি শ্রেণি হলো, যে ব্যবসায়ী মিথ্যা শপথ করে বিক্রয় করে। (মুসলিম)

বরকতহীন উপার্জন
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাধ্যমে যে অর্থই উপার্জিত হোক না কেন, তাতে কোনো বরকত থাকে না এবং এ সম্পদ দান করলে তাতে সওয়াবও পাওয়া যায় না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বৈধ পন্থায় ধনসম্পদ উপার্জন করে, তার সম্পদে বরকত দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে, তার উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মতো, যে খায় কিন্তু তা দ্বারা সে পরিতৃপ্ত হয় না।’ (মুসলিম)

মহানবী আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় সম্পদ সঞ্চয় করে তা দান করে, সে ওই দানের জন্য কোনো সওয়াব পাবে না এবং তার পাপ তাকে ভোগ করতে হবে।’ (সহিহ ইবন হিব্বান)

ইবাদত কবুলে প্রতিবন্ধকতা
খাদ্যে ভেজালদাতাদের উপার্জন অবৈধ। আর অবৈধ উপার্জন দ্বারা শরীর গঠিত হলে তার কোনো ইবাদত কবুল হয় না। ইবাদত কবুলের প্রধান শর্ত হলো, বৈধ উপার্জন। একদা মহানবী (সা.) তাঁর ভাষণে বলেন, ‘হে লোকসকল, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্র ছাড়া কোনো কিছুই গ্রহণ করেন না। এরপর তিনি একজন মানুষের কথা বলেন, যিনি দীর্ঘ সফর শেষে এলোমেলো চুল ও ধুলায় মলিন অবস্থায় উভয় হাত ওপরে তুলে হে প্রভু, হে প্রভু বলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন। এমতাবস্থায় তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার শরীর গঠিত হয়েছে। তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম)

কিয়ামতের দিনে অসহায়ত্ব
কারও সম্পদ আত্মসাৎ করা ইসলাম সমর্থন করে না। খাদ্যে ভেজাল দানকারীরা মূলত অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী এবং বান্দার হক নষ্টকারী। বান্দা ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ এ পাপ কখনো ক্ষমা করেন না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জানো গরিব কে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আমাদের মধ্যে তো গরিব তাদের বলা হয়, যাদের কাছে ধনসম্পদ ও দিরহাম নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমার উম্মতের মধ্যে গরিব সে-ই, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাতের সওয়াব নিয়ে উঠবে, কিন্তু দুনিয়ায় সে কারও সঙ্গে মন্দ আচরণ করেছে, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও হক নষ্ট করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কাউকে খুন করেছে। সেদিন তার অর্জিত সওয়াব দ্বারা সব হকদারের পাওনা পরিশোধ করা হবে। যদি তার সওয়াব শেষ হয়ে যায় তাহলে এই হকদারদের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)

জীবনোপকরণ হিসেবে মানবজীবনে খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনীশক্তি ও কর্মক্ষমতা খাদ্যের ওপরেই নির্ভরশীল। তাই খাদ্য যাতে ভেজালমুক্ত থাকে এ ব্যাপারে সমাজের সব শ্রেণির নাগরিককে সচেতন হতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত