Ajker Patrika

সংযমের মাস: অতঃপর

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ১৩: ৫৪
সংযমের মাস: অতঃপর

সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে। এ মাস ইবাদতের, সংযমের এবং ঈদের আনন্দের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ সময় সাধারণ মানুষের জন্য জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। অনেকে কয়েক মাসের বাজার এ সময় করে থাকে। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যেমন ক্রিসমাসে বা পূজোর সময় এ সুযোগটা পেয়ে থাকে। কিন্তু একটা বড় ব্যতিক্রম আমাদের দেশে দেখা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে এ ব্যাপারে একেবারেই উল্টো ঘটনা ঘটে।

সরকার দু-তিন মাস আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের নানাভাবে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল রোজার মাসে যেন দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে। কেউ মানেনি। খেজুরের দাম একলাফে বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে সবকিছুর দামই বাড়তি। এমনি করেই একসময় মানুষ মনে করবে—রোজায় তো একটু বাড়বেই! বাজারে যদি খাদ্যদ্রব্যের আকাল থাকে তাহলে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু কোথাও তো আকাল নেই। বাজারে মাছ, মাংস, সবজি সবই অঢেল। এখন তো আর বাজার শুধু নির্ধারিত এলাকায় নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র—গলিতে, রাজপথের ফুটপাতে, ফ্লাইওভারের নিচে, পাড়া-মহল্লায়। কখনো মনে হয় বাংলাদেশ আসলে একটা বৃহৎ দোকান।

বড় ও ছোট ব্যবসায়ীদের একটা বিষয়ে ঐক্য মারাত্মক—দাম কমানো যাবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রাখতে হবে। সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোথাও ঐক্য নেই, কিন্তু ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে ঐক্য অসাধারণ। যে রোজার মাসে মুসলিম বিশ্ব সংযমের কথা বলে, সেই মাসকে আমাদের ব্যবসায়ীরা একটা মুনাফার মাস বলে গণ্য করেন। শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁয় নয়, রাস্তাঘাটেও ইফতারির দোকান বসে যায়। কে তোয়াক্কা করে স্বাস্থ্যের কথা?

ইতিমধ্যেই চিকিৎসকেরা বলতে শুরু করেছেন দেশে ক্যানসারের বড় কারণ খাদ্য। চাষের মাছ, রাসায়নিক প্রক্রিয়ার শাকসবজি, মুরগি, ডিমসহ সব খাদ্যেই ক্যানসারের বীজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আর ভোজ্যতেলের তো কথাই নেই। বিদেশে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা করতে গেলে চিকিৎসকেরা প্রথমেই তেলের কথা বলেন। দিল্লির এক হাসপাতালের চিকিৎসক তাঁর টেবিলের সামনে বেশ কয়েকটি তেলের স্যাম্পল রেখে দেন এবং রোগীদের জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা কোন তেলের রান্না খেয়ে থাকেন। পরে তিনি মানবদেহে ওই তেলের ভয়ংকর সব প্রতিক্রিয়ার কথা বলেন।

সংযম বহু প্রকার। খাদ্যে সংযমের কথা যদি বলা হয় তাহলে এই অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত তেল-মসলা ছাড়া খাবারে রুচিই হয় না তাদের! রোজার সময় সাধারণত ১৪-১৫ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হয়। তারপর ইফতারের সময় থালা বোঝাই করে আসে সব ভাজাপোড়া। সামান্য ফল ছাড়া অধিকাংশই কড়া তেলে ভাজা খাবার। আজকাল এই সঙ্গে থাকে পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি। খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন সুবিধা পেয়ে যান। দাম বাড়ানোর সুবিধা ছাড়াও প্রয়োজনে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার ব্যবস্থা হয়। সরকার মজুতদারির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও তা এক নিষ্ফলা হাহাকারের মতোই শোনা যায়।

মোগল আমলে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থার কথা এখনো প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এই ঢাকা শহরেই চকবাজারে সকালবেলায় মোগলদের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কর্মচারী ছিলেন, যিনি এসে জিনিসপত্রের দামের একটা ঘোষণা দিয়ে দিতেন। কেউ অমান্য করলে তাকে দণ্ড দেওয়া হতো। বহু বছর ঢাকায় এবং বড় বড় শহরে এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ফলে দ্রব্যমূল্য সব সময়ই আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের পর এই ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। নিজেরাই ব্যবসার নামে লুণ্ঠন করতে থাকে। যে ঢাকায় টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত, মাত্র পনেরো বছরের ব্যবধানে তা টাকায় ছয় সেরে পরিণত হয়। কোম্পানি ১৭৭৬ সালে বড় ধরনের মন্বন্তর ঘটিয়ে দেয়। যে মন্বন্তরে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় বিপুল পরিমাণ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে।

নানা ধরনের প্রযুক্তি ও সার প্রয়োগের ফলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে নানা ধরনের ফল ও সবজির চাষ যেন সত্যিকারের ধনধান্য পুষ্পভরা দেশের পথে নিয়ে চলেছে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদনকারী কৃষক। প্রতিটি মৌসুমেই দেখা যায় ক্ষুব্ধ কৃষক তাঁর ফসলের দাম না পেয়ে বাজারেই ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। অথচ এই কৃষিপণ্যটি তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ মূল্যে বাজারে বিপণন হচ্ছে।

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। ১৯৭২ সালের পরে তারা শিশুখাদ্য, কাপড়, খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল যে ওই সময়ের শিশুরা নিদারুণ অপুষ্টি নিয়ে বড় হয়েছে।

এই সব ব্যবসায়ী আবার নামাজ-রোজা করেন, দান-খয়রাতও করেন, ঘন ঘন হজ বা ওমরাহ করতে যান। রোজার মাসটায় ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারলে সারা বছরের জন্য তাঁদের একটা নতুন পুঁজি তৈরি হয়ে যায়। তাহলে রোজার যে বাণী, সংযম, তা থাকল কোথায়? 
সংযমের বাঁধ ভেঙে যায় দুর্নীতিবাজদের। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ এই রোজা ও ঈদের অপেক্ষা করতে থাকেন, কারণ এই সময়টা তাঁদের জন্য অবৈধ অর্থ উপার্জনের একটা বড় মওকা। তাঁরা কৌশলে নিজের কথার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার কথা বেশি বেশি বলে থাকেন গ্রাহকদের কাছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ-বাণিজ্যের একটা বড় দুর্নীতির স্থান। কিন্তু এসব জায়গায় আবার শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে ঈদের বখরা পেতেই হয়! সারা বছর চাঁদাবাজি হলেও এই সময় রাজনীতির ছোট-বড় মাস্তানেরা ঈদের দোহাই দিয়ে বড় চাঁদাটি তুলবে। তাহলে সংযমটা কোথায় থাকছে?

ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো যখন উল্টোপথে চলছে, তখনই ধর্মের বাণী মানুষকে আর সংযমী করে তোলে না। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলোতে যত বেশি ধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, ততই সমাজ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠছে। আমলাতন্ত্র এ ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হিসেবে এগিয়ে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে এটাই দাঁড়াচ্ছে—খাদ্যে, নীতি-নৈতিকতায়, ব্যবসাকর্মে, দুর্নীতিতে, রাজনীতিতে কোথাও সংযমের উদাহরণ তৈরি হচ্ছে না। অথচ রোজার এই চান্দ্রমাসে অন্তত শুদ্ধাচারের কিছু মহড়া দেওয়া যেত। ধর্ম কি তাহলে শুধু হিজাব, বোরকা, মাদ্রাসা, মসজিদেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি জীবনে যাঁদের হররোজ রোজা, যাঁরা ইফতার করেন পানি আর মুড়ি খেয়ে, তাঁদের কথাও ভাববে?

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত