Ajker Patrika

আলুর বাজার অস্থির হওয়ার কারণ কী

হাসান মামুন
আলুর বাজার অস্থির হওয়ার কারণ কী

আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল নিয়ে সংকট উপস্থিত হলে আটা-ময়দার পরিভোগ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা অনেকে বলে থাকেন। কখনো কখনো এমন সময় অবশ্য আসে, যখন চাল ও আটা দুটোরই দাম বাড়ে।

তখন এই স্লোগান সামনে আনার চেষ্টা হয় যে ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’। কিছু দেশ ও জনগোষ্ঠীতে আলু কালক্রমে প্রধান খাদ্য হয়ে উঠেছে বৈকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর ব্যবহার বেড়েছে বিশ্বজুড়ে। এ দেশেও আলুর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। উৎপাদনও বেড়েছে দ্রুত।

আলু চাষে জমির ব্যবহার ও একরপ্রতি ফলন বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। উন্নত বীজের ব্যবহার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আমরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আলু উৎপাদন করছি। তাতে এ কথাটাও উঠেছে যে আলুর রপ্তানি বাড়ানো দরকার। তাতে বিদেশি মুদ্রার আয়ই শুধু বাড়বে না; দেশে চাহিদার চাপ বাড়লে এতে করে বেড়ে যাবে আলুচাষির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা।

মালয়েশিয়াসহ গোটাকতক দেশে আমরা খুব অল্প পরিমাণ আলু রপ্তানি করি। আরও যেসব দেশে রপ্তানি বাড়ানো যায়, সেখানে কিছু প্রতিবন্ধকতা নিশ্চয়ই রয়েছে। সম্প্রতি খবর মিলেছিল, রাশিয়ায় আলু রপ্তানি আবার শুরু হবে। আলু উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশ হলেও রাশিয়া কম আলু আমদানি করে না।

এমন আরও কিছু দেশ খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে আলু রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের চেয়ে অনেক কম আলু উৎপাদন করে পাকিস্তান অনেক বেশি রপ্তানি করে কীভাবে, সে প্রশ্নও আছে। তারা সম্ভবত রপ্তানিযোগ্য ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য আলু উৎপাদনে আছে এগিয়ে।

নিজ দেশে প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করে আলুপণ্য; যেমন চিপস, ওয়েজেস, বিস্কুট উৎপাদন করা গেলে অনেক বেশি দাম পাওয়ার সম্ভাবনা। সব ক্ষেত্রেই যতটা সম্ভব মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। তাতে ওই সব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ারও সম্ভাবনা।

নিজেদের চাহিদা মেটানোর পরও কিছু আলু থেকে যাচ্ছে বলেই রপ্তানির ওপর এভাবে জোর দেওয়া। খোদ কৃষি মন্ত্রণালয় আলু রপ্তানিতে জোর দিচ্ছে। রপ্তানির প্রসঙ্গ এলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এসে যায়। আসে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার প্রশ্ন। আলু রপ্তানিতে তাদের অভিজ্ঞতাও আমরা জানতে চাইব।

এতে সরকার কিছু প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ পরিস্থিতি কেমন, সে প্রশ্নও উঠবে। তবে আলুর উৎপাদন থেকে নিয়ে এর বাজারজাতকরণ, হিমাগারে সংরক্ষণ ও রপ্তানি—সবখানেই সযত্ন দৃষ্টি দিতে হবে সরকারকে। কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা যেন একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকে।

নইলে আলুর উৎপাদন অনেক বাড়ানো গেলেও এর অংশীজনদের মধ্যে আস্থা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ধারাবাহিক হয়ে উঠলে শেষে উৎপাদনেই আগ্রহ হারাবেন কৃষক। আলুর বদলে তিনি তখন অন্য ফসল উৎপাদনে মনোনিবেশ করবেন। নিত্যনতুন ফসলে কৃষকের আগ্রহ কিন্তু বেড়েছে। বেড়েছে তাঁর চয়েস বা পছন্দ। বাণিজ্যিক মনোভাবও বেড়েছে বৈকি। সেটা দোষেরও নয়।

নিবন্ধের শুরুতে রপ্তানির প্রসঙ্গ এলেও এবার কিন্তু আলুর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় এ প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন, দাম কমিয়ে আনতে পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচের মতো আলুও আমদানি করতে হবে কি না।

কারণ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে যদিও বলা হচ্ছে, ১ কোটি ১০ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে; কিন্তু হিমাগারমালিক ও বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন এবার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, হিমাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার চেয়ে কম আলু এবার সংরক্ষণ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

হিমাগারমালিকেরাও কিছু আলু কিনে সংরক্ষণ করে থাকেন। উত্তোলনের পর যেটুকু ইতিমধ্যে ভোগে চলে গেছে, তার বাইরে খোদ কৃষকের হাতে আলু আর তেমন সংরক্ষিত আছে বলে মনে হয় না। কিছু কৃষক আলু সংরক্ষণ করে ক্ষতিগ্রস্তও হয়ে থাকেন। সংরক্ষণে তাঁরা প্রশিক্ষিত নন। বীজ নির্বাচনেও রয়েছে দক্ষতার অভাব। আলু চাষে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে, যেটা ঘটেছে অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও। সিংহভাগ কৃষকের পক্ষে বেশি দামের আশায় আলু ধরে রাখার সুযোগও কম।

তাঁর দ্রুত চাই নগদ অর্থ—সেটা ঋণ পরিশোধ বা অন্যান্য জরুরি ব্যয় নির্বাহের জন্য। এর সুযোগ ব্যবসায়ীরা নেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আলু কিনে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার ক্ষমতাও তাঁদের রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরাও কেনার মতো আলু নাকি এবার পেয়েছেন কম। তাই হিমাগারে আলু কম সংরক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায় ব্যর্থ কিছু হিমাগার বন্ধও হয়ে গেছে।

এদিকে সরকার তো চালের মতো আলু সংরক্ষণ করে না। এ অবস্থায় হিসাব করে বলা হচ্ছে, এক কোটি টন আলু উৎপাদিত হওয়ার তথ্যও সঠিক নয়। উৎপাদন নাকি হয়েছে ঘোষিত তথ্যের চেয়ে ২০ শতাংশ কম! শুধু কৃষিপণ্য নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দেশে কম বলে অভিযোগ কিন্তু জোরালো।

সম্প্রতি আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের প্রকৃত রপ্তানি নিয়েও দুই রকম তথ্য দেওয়া হয়েছে দুই সরকারি সূত্র থেকে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও বিতর্ক আছে। উন্নয়ন-সহযোগীর চাপে এসব ক্ষেত্রে হিসাবায়ন পদ্ধতিও করতে হচ্ছে সংশোধন। কথা হলো, কোনো খাতের সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ভুল পদক্ষেপও নেওয়া হয়। উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে ঘটে বিলম্ব। তাতে বাজার হয়ে পড়ে অস্থির। কিছুদিন আগে কাঁচা মরিচের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল। বৃষ্টিবাদল শুধু নয়, তাপপ্রবাহেও যে এর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেদিকে দৃষ্টি ছিল না কৃষি বিভাগের। বিভ্রান্ত হয়েই বোধ হয় তারা সময়মতো আমদানির অনুমোদনে গা করেনি।

এই ফাঁকে মূল্যবৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়ে যায়। আলুর দামও কিন্তু লাফিয়ে বেড়েছে এবং বৃদ্ধি অব্যাহত। নিবন্ধটি লেখার সময় খোঁজ নিয়ে জেনেছি, লম্বাটে সাদা ও ঈষৎ লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা কেজি। গত বছর এই সময়ে দাম ২৮-৩০ টাকার বেশি ছিল না। গেল কোরবানি ঈদের সময়ও আলু এ দামেই বিক্রি হচ্ছিল।

আলুর দাম এভাবে বেড়ে যাওয়াটাকে কি শুধু ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজি’ বলে ব্যাখ্যা করা যাবে? তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে, সঙ্গে হিমাগারমালিকদের নিয়ে ধীরগতিতে আলু ছেড়ে সংকট তৈরি করে অস্বাভাবিক মুনাফা তুলছেন, এমন অভিযোগ তোলা গেলেও সেটা প্রমাণ করা কঠিন। দৃশ্যত বাজারে আলুর ঘাটতি নেই। আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহনসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে হিমাগার থেকে আলু আনতে হচ্ছে বেশি দামে। তাই বেশি দামে বেচতেও হচ্ছে।

আলু এবার অনেক বেশি রপ্তানি হয়ে গেছে বলেও খবর নেই। দেশীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এর ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে বলেও মনে হয় না। এদিকে অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতো বিভিন্ন পর্যায়ে আলুর অপচয় বেশি। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলুবীজ হিসেবেও সংরক্ষণ করা হয়। সব মিলিয়ে দেখলে, উৎপাদন এবার কম হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণটাই সঠিক মনে হতে পারে।

বিশেষ করে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো, ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ অর্জন এবং তা ধরে রাখার দাবিতে সত্যতা না থাকলে সেটা কিন্তু মুশকিলের। তখন দেখা যাবে, ঘাটতি মেটাতে আমদানি জরুরি হলেও আমরা আত্মতুষ্ট হয়ে সেটা করছি না। হয়তো দেখা যাবে, উল্টো তখন করে চলেছি রপ্তানি। আলুর ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে কি না, কে জানে! উৎপাদন কম হয়ে থাকলে আমাদের কিন্তু এর রপ্তানি অবিলম্বে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

সম্প্রতি ভারত এমনকি চাল রপ্তানি নিরুৎসাহিত করার নীতি নিয়েছে—যদিও দেশটি এখন সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। সামনে ভারতের জাতীয় নির্বাচন এবং সে কারণেও অভ্যন্তরীণ চালের বাজার শান্ত রাখা প্রয়োজন। এই পূর্বাভাসও আছে যে আবহাওয়ার বিচিত্র আচরণে এবার বিশ্বজুড়েই খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে। 

আমাদের আলুর উৎপাদন কমে গিয়ে থাকলে দেখতে হবে, ঠিক কী কারণে কমেছে। উৎপাদন তো অব্যাহতভাবে বাড়ছিল। কৃষকও যে কখনোই ভালো দাম পাচ্ছিলেন না, তা নয়। ভোক্তাও আলুর স্বাভাবিক দামে সন্তুষ্ট ছিল বেশির ভাগ সময়। এই বাজারে আলুর মতো নিত্যপণ্যের দাম ৭০-৭৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার কারণ কি তবে এর চাহিদা বৃদ্ধি? অন্যান্য সবজির দাম বেড়ে যাওয়া? চাল, আটার দাম বেড়ে যাওয়াতেও কি আলুর পরিভোগ বেড়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে? 

এই মুহূর্তে কিন্তু মোটা চাল ও আলুর দাম সমান। তিন নম্বর গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য হিসেবে আলুর সহজলভ্যতার প্রভাব নিশ্চয়ই আমরা বুঝি। এর মূল্যবৃদ্ধি রোধে তাই দ্রুতই যা করার করতে হবে। সেটা এ জন্যও যে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়ছে কিংবা ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘালয়ে হানিমুনের সময় ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামীকে হত্যা, উত্তর প্রদেশে নববধূর আত্মসমর্পণ

ভিকারুননিসার ছাত্রী মেয়েকে সাঁতার শেখাচ্ছিলেন বাবা, ডুবে প্রাণ গেল দুজনেরই

মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় খুন—কীভাবে এক নববধূ হয়ে উঠলেন হত্যাকারী

কানাডার লেকে বোট উল্টে বাংলাদেশের পাইলট ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

এআই যুগে চাকরি পেতে যে দক্ষতা লাগবেই, জানালেন মাইক্রোসফটের সিইও

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত