Ajker Patrika

পোশাকশিল্পে অস্থিরতা: স্বপ্ন দেখতে সমস্যা কী

মিজানুর রহমান
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮: ১০
Thumbnail image

২০২৪ সালটি তৈরি পোশাকশিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হতে পারবে মনে হচ্ছিল। এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। প্রথম অবস্থানে চীন। বর্তমান বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেখানে চীনের হিস্যা ৩১ শতাংশের কিছু বেশি। দেশে এ সেক্টরে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ রকম বিশাল কর্মসংস্থান আর কোনো সেক্টরে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতে মোট লোকবল আছে ৪৩ লাখ ১৬ হাজার। এর ৬২ শতাংশ নারী শ্রমিক। কারখানা আছে ৪ হাজার ১১৪টি। গত দুই অর্থবছরের চিত্র অনুযায়ী পোশাক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ছিল। যেমন, ২০২২ সালে ৪ হাজার কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। মোট রপ্তানির  ৮১ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অথচ এই তৈরি পোশাকশিল্পের কার্যক্রম এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তৈরি পোশাক কারখানার চলমান অস্থিরতায় পোশাক খাতকে সমস্যায় ফেলেছে। বাংলাদেশের বিকল্প দেশে রপ্তানি অর্ডার চলে যাচ্ছে। কারখানার মালিকদের ধারণা, কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রপ্তানি অর্ডার প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব রপ্তানি অর্ডারের বড় অংশ যাচ্ছে ভারত এবং পাকিস্তানে। অর্ডার বাতিল হলে পুনরায় ফিরিয়ে আনা খুবই দুষ্কর। সাম্প্রতিক বন্যা ও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কারণে এর আগে-পরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান হওয়ায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে আসছেন না।

সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে পণ্য ডেলিভারিতে বিলম্ব করার কারণে চুক্তিবদ্ধ মূল্যের চেয়ে কম মূল্য পরিশোধে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়। চুক্তির শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ২০০-২৫০ গুণ বেশি ব্যয়ে আকাশপথে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাও হাতে নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে লাভের চেয়ে সুনাম রক্ষা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। 

উৎপাদন হওয়ার পর রপ্তানি আদেশ বাতিল হলে ‘স্টকলট’ হিসেবে স্থানীয় বাজারে সস্তায় মালামাল বিক্রি করে দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে পুঁজি উদ্ধার করাই কঠিন হয়ে পড়ে। অতীতে এ রকম ঘটনার কারণে অনেক কারখানার মালিক দেউলিয়া হয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ। এর সঙ্গে আছে তীব্র গ্যাস, বিদ্যুৎ-সংকট। তা ছাড়া, বন্দরের অহেতুক ঝামেলা তো আছেই, যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় নেই। এসব ঘটনায় উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বাইরের ক্রেতার কাছে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের ভাবমূর্তি দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে।  

কিছুদিন আগে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ায় আন্দোলনের মুখে মালিকপক্ষও বেকায়দা অবস্থায় পড়েছিল। সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্প অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ বেড়ে চলছিল। নিরুপায় হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। যে কারখানা শ্রমিকদের চাকরিতে নিয়োগ দিল, সময়মতো বেতন ও ভাতা পাচ্ছিল, তার প্রতি কেন ক্ষোভ থাকবে? মালিকের প্রতি ক্ষোভ কেন কারখানার ওপর চড়াও হবে? এবারের বিক্ষোভে গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় বিগবস করপোরেশন নামে একটি কারখানার গুদামে অগ্নিসংযোগ করা হলো। কারখানায় উৎপাদন কী করে হবে? শ্রমিকেরা কি সেটা ভেবে দেখেছেন? 

শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও অসন্তোষ কমেনি, বরং নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক দাবি তুলে কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিকেরা। প্রথমে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নামেন শ্রমিকেরা। পরে তাঁরা চাকরির ক্ষেত্রে সমতার দাবিও জানান। পাশাপাশি তাঁরা বেকারদের জন্য চাকরি ও চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালের দাবি তোলেন। কর্মী ছাঁটাই করার বিষয়টিও আনেন। শ্রমিকনেতা ও মালিকপক্ষ তাঁদের সব দাবি-দাওয়া যৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা মনে করেন, যে ধরনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা সব পূরণযোগ্য নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও। 

সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুট ব্যবসার দখল নিয়ে গ্রুপিং হচ্ছে। দখলদারত্ব তো আছেই। কেউ কারখানায় খাবার সাপ্লাই দেয়, তাদেরও স্বার্থ আছে। সেখানেও শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। গত জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল। শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ৪৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তাঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এখন দাবিতে আসছে। তা ছাড়া, বহিরাগত একটি শক্তির তৈরি পোশাক কারখানায় অসন্তোষ সৃষ্টি করার একটি অশুভ চিন্তাও থাকতে পারে। 

তৈরি পোশাক কারখানার অরাজকতায় ১১ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে ‘শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ বিষয়ক মতবিনিময় সভা হয়। 

সেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তো ‘গরিবের বন্ধু’ নামে পরিচিত। তাঁর ওপর ভরসা রাখতে তাহলে দ্বিধা কেন? জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, শ্রমিক ভাইবোনদের অনেক দুঃখ আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করা হবে। 

মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আস্থা রাখতে আমাদের ক্ষতি কী? আশা করি, তাঁর মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্পের বাজার আরও ব্যাপক হারে সম্প্রসারিত হবে। আমরা একটু অপেক্ষায় থাকি। সবার ধারণা, অদূর ভবিষ্যতে তৈরি পোশাকশিল্পের বাজার বিশ্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে। তখন শ্রমিক ভাইবোনদের বেতন-ভাতা নিয়ে আর হয়তো আন্দোলন করতে হবে না। আমাদের সেই স্বপ্ন দেখতে সমস্যা কী?

লেখক: মিজানুর রহমান, ব্যাংকার ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত