Ajker Patrika

দিল্লি-কলকাতায় সম্প্রতি...

ড. মো. গোলাম রহমান
Thumbnail image

দিল্লিতে একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স শেষ করে কলকাতা এসেছি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আরও অনেক দেশের লোকজন অংশ নিয়েছিলেন এই কনফারেন্সে। দিল্লি মানে তো গোটা ভারতের লোকজনের দেখা পাওয়া, সেই সঙ্গে বিদেশিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলা আর শোনার সুযোগ। বিশ্ব সমস্যার আড়ালে প্রতিটি মানুষের সামাজিক, স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক—কত রকমের বিষয়-আশয় আছে যে আমরা অনেক ক্ষেত্রে তেমন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে চাই না। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, তরুণ সমাজ, শিশু ও নারীদের নিয়ে কর্মকৌশল সভায় অংশ নিয়ে দেশে ফিরেছি। পরে কোনো সুযোগে সে কথা বিস্তারিত বলা যাবে।

কলকাতা আনন্দের শহর, ‘সিটি অব জয়’ বলে খ্যাত। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা রাজনীতিতে সব সময় মুখর। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কমবেশি সেই সব বিষয় আমরা অবগত আছি। আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়েও কলকাতার লোকজনের আগ্রহের শেষ নেই, সংগত কারণেই। জানা যায়, একক বা একাধিক গমন-পুনর্গমনের প্রায় ছয় হাজার ভিসা নিয়ে গড়পড়তা হাজার দশেক লোক প্রতিদিন ভারতে আসে-যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ ছাড়াও সেমিনার, কনফারেন্স—এসব তো আছেই। তাই ভারতের সঙ্গে মেলবন্ধন শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক কারণেই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ কারণেও। ভারতে মূল্যস্ফীতির ফলে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই সে দেশে জোগান বাড়িয়ে দাম কমাতে সরকার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেছে বলে দৈনিক ‘এই সময়’ সংবাদ দিয়েছে। গত ১৫ দিনে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এটি ভারতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। সে দেশের এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, এসব পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু পেঁয়াজ দ্রুত পচনশীল হওয়ায় সে রকম মূল্য নির্ধারণ করা হয় না। রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধির ফলে সে দেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা চটেছেন, তাঁরা হুমকি দিচ্ছেন, রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহার না করলে বড় রকমের আন্দোলনে যাবেন। এদিকে সরকারিভাবে বাফার স্টক থেকে বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাসমতী চাল ব্যতীত অন্যান্য চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা রক্ষণশীল হয়েছে। এসব কারণে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে—এটাই স্বাভাবিক।

এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হোস্টেলে গত ৯ আগস্ট এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে র‍্যাগিংয়ের ঘটনা যুক্ত বলে বলা হচ্ছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এ কথাই উঠে এসেছে। সেখানে প্রায়ই র‍্যাগিং হয় এবং অতীতেও হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি বলেছে। র‍্যাগিংয়ের সংস্কৃতিকে ছাত্র নেতারাসহ যাঁরা প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়েছে এই রিপোর্টে। এ ঘটনার আগে, জানা যায় হাওড়ার শিবপুর আইআইএসটিতে (তৎকালীন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি) ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট ১১ নম্বর হোস্টেলের দোতলার বারান্দার কার্নিশে জমে থাকা শেওলায় পা পিছলে এক শিক্ষার্থী মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অবস্থার অবনতি হলে ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। সেই শিক্ষার্থীর নাম ছিল সৌমিক বসু। সে সময় দুই ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে থাকত। কথায় কথায় লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে হামলা হতো পরস্পরের। অভিযোগ ছিল র‍্যাগিংয়েরও। তার আগের রাতে র‍্যাগিংয়ের ঘটনা জানাজানি হয়ে যায় এই আশঙ্কায় ছুটে পালাতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল সৌমিকের। এ ঘটনার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল র‍্যাগিং এবং সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের জন্য। ফলে সন্ত্রাস ও র‍্যাগিং—দুটোই কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর শোকে র‍্যাগিং বন্ধ করেছিল ছাত্রসমাজ।

কিন্তু গত বছর ঘটনার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জোর করে নবাগত শিক্ষার্থীদের স্টেজে তুলে তাঁদের যৌন দৃশ্যে অভিনয় করতে বাধ্য করেন। এসব ঘটনার ছবি, ভিডিওসহ বেনামে অভিযোগ পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে, অতঃপর মঞ্জুরি কমিশনের পদক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কড়াকড়ি আরোপ করে। বিভাগীয় অধ্যাপকের উপস্থিতিতে বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠান শেষ করা হয় এবং শিক্ষার্থীরা যেন কোনো অশোভন আচরণের মুখোমুখি না হন, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। এই পরিস্থিতিতে এক ছাত্র নেতাকে পদত্যাগও করতে হয়েছিল। তাতে করে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এসব ঘটনাবলি থেকে পারস্পরিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। এই সবকিছুর ভয়াবহ প্রভাব যে আমাদের দেশে পড়বে তা মনে করার কারণ নেই, আবার এর ‘স্পিল ওভার ইফেক্ট’ যে হবে না, সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রসঙ্গত, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) সম্প্রতি র‍্যাগিংয়ে জড়িত ছয় শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরও তিন শিক্ষার্থীকে সতর্ক করা হয়েছে লিখিতভাবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. সাইফুর রহমান পৃথক পত্রে বিষয়টি সেই সব শিক্ষার্থীর জানিয়ে দিয়েছেন। (আজকের পত্রিকা ৩০-০৮-২০২৩ দ্রষ্টব্য) 
গোটা ভারতে উল্লেখ করার মতো আরেকটি বিষয় হচ্ছে ভারতের চন্দ্রযান-৩ বিক্রমের অভিযান সফল করে চাঁদে অবতরণের ঐতিহাসিক ঘটনায় পুরো ভারত ব্যাপক আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সে সময় ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখান থেকে তিনি এই সফলতায় বাণী দিয়েছেন, তাঁদের পতাকা উড়িয়েছেন। তারপর গ্রিস সফর শেষে দেশে ফিরেই দ্রুত তিনি বেঙ্গালুরু ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (ইসরো) সদর দপ্তরে পৌঁছে যান। তিনি এই অনুষ্ঠানে পৌঁছানোর সময় কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালকে উপস্থিত না থাকার জন্য জানিয়েছিলেন। কারণ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি এসে পৌঁছাবেন তাতে করে প্রটোকল রক্ষা করে তাঁদের উপস্থিত হওয়া হয়তো জটিলতার সৃষ্টি করতে পারত, এই ভেবে। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেছেন যে চন্দ্রাভিযানের সাফল্যে তাঁর আর তর সইছিল না, তাই তিনি সরাসরি ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। এতে অবশ্য বিরোধীরা একে রাজনীতি করার অভিযোগ তোলেন তাঁর এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে। কথা উঠেছে, যেভাবে প্রধানমন্ত্রী সেই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালকে না নিয়ে সরাসরি ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাতে তিনি নিজেই প্রটোকল ভেঙেছেন। আবেগ ও প্রটোকল ভাঙার দ্বন্দ্ব রাজনীতিতে বেশ আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে বিরোধীশিবিরে। হয়তো এ আলোচনা খুব বেশি এগোবে না, অন্য কোনো বড় ঘটনায় চাপা পড়ে যাবে। 

আরেকটি মজার কথা বলে শেষ করি। চন্দ্রযান-৩ বিক্রমের অভিযান শেষ করতে বাজেট কাটছাঁটের যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইসরোর নারী মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁদের উজ্জ্বল মুখগুলো আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি। তাঁদের মধ্যে আছেন কে কল্পনা, ঋতু কারিধাল, মুথাইয়া বনিতা, টি কে অনুরাধা, নান্দিনী হরিনাথ, ভি আর ললিতাম্বিকা, মৌমিতা দত্ত, মাধুরী পিল্লালা এবং আরও কয়েকজন। নিজ নিজ বাড়িতে খরচাপাতি হিসাব করার সুবাদেই হয়তো চন্দ্রযানের বাজেটে তাঁরা হিসাবি পরিকল্পনায় এগিয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণ থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি ইত্যাদি। ‘ওপেনহাইমার’ ৮২৬ কোটি, ‘গ্র্যাভিটি’ ৬৪৪ কোটি ও ‘ইন্টারস্টেলার’ ১২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে, সে ক্ষেত্রে সাম্প্রতিকতায় বাজেট না বেড়ে বরং মাত্র ৬১৫ কোটিতে স্থির থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ডিং, যথেষ্ট কৃতিত্বের ব্যাপার। ভারতের নারী বিজ্ঞানীদের ব্যয় সাশ্রয় এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

লেখক: সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত