সাইফুল মাসুম, ঢাকা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছে তিন চক্র। এই তিন চক্রে আছেন প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি এবং স্থানীয় দালালেরা। খোঁজ নিয়ে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুষ, প্রকৃত কৃষকদের বদলে অন্যদের যন্ত্র পাওয়া, যন্ত্র নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র একাধিকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ নানা অভিযোগও উঠেছে এই প্রকল্পে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও প্রকল্পের বেশ কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে। তবে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, অনিয়মের কোনো তথ্য তাঁদের জানা নেই। কিছু কোম্পানির অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্ত করছি। সমস্যা নিরসনে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কিছু নির্দেশনাও দিয়েছি। আমরা চাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের কৃষিব্যবস্থার উন্নতি।’
কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে সরকার এই ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প নিয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে হাওর ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা ৭০ শতাংশ এবং অন্য সব এলাকার কৃষকেরা ৫০ শতাংশ ভর্তুকি পাবেন।
কৃষকেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষক ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র পাচ্ছেন না। ঘুষ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরাও সমস্যায় পড়ছেন। যন্ত্র নষ্ট হলে কোম্পানি মেরামত করে দিচ্ছে না। যন্ত্রাংশের দাম রাখছে বেশি। যন্ত্রের দামও বেশি রাখার অভিযোগ আছে। আবার কেউ কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে যন্ত্র নিয়ে অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে কোম্পানি। আবার ভর্তুকি নিচ্ছে। কোম্পানিগুলোকে সহযোগিতা করছেন কিছু অসাধু কৃষি কর্মকর্তা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের যন্ত্রের ভর্তুকির সুবিধা পকেটে ঢোকাতে সক্রিয় তিন চক্রের একটিতে আছেন অসাধু কৃষি কর্মকর্তারা। আরেকটি চক্র হচ্ছে যন্ত্র সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানি। তৃতীয় চক্রে আছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দালাল। যাঁরা মূলত ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সুপারিশে উপজেলা কর্মকর্তারা কৃষকের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ঘুষ হাতবদল হয় তাঁদের মাধ্যমে। অনেক সময় দালালেরা নিজেদের নামেই ভর্তুকিতে যন্ত্র কিনে বিক্রি করেন।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে টি সিডার (পাওয়ার টিলারের সঙ্গে বীজ বপন যন্ত্র) কেনেন আমির হোসেন সাজু। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার পশ্চিম সোনাদিয়ার বাসিন্দা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সরাসরি কৃষিকাজে জড়িত নন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আমির পরে যন্ত্রটি বিক্রি করে দেন। তবে নিজেকে কৃষক দাবি করে আমির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ট্রাক্টর পেয়েছি। যেভাবে বলছে সেভাবে দিয়েছি। কত টাকা ভর্তুকি দিয়েছে মনে নেই।’
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল বাছেদ সবুজ বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে দু-একজন পেতে পারেন। তবে আমরা অবহিত না।’কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার কৃষক আনিসুর রহমান অভিযোগ করেছেন যন্ত্রের দাম বেশি নেওয়ার। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আবেদীন ইকুইপমেন্ট লিমিটেড থেকে বেশি দামে কেনা কম্বাইন হারভেস্টারের ইঞ্জিন তিন মাসেই নষ্ট হয়ে গেছে। চুক্তিতে কোম্পানির মেরামতের কথা থাকলেও দেয়নি। তাঁদের উপজেলায় ওই কোম্পানি পাঁচটি কৃষিযন্ত্র বিক্রি করেছে। এর তিনটি নিয়ে গিয়ে আবার অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা যন্ত্র ভালোভাবে যাচাই করেননি। মাঝখানে প্রতারণায় পড়েছেন কৃষকেরা।
গত ৩০ জুন প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারিগরি কমিটির নির্দেশনা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাব মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বাজারদর যাচাই না করে উচ্চ দরে যন্ত্র কেনা, নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহ করা হলেও জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটিতে উপকারভোগী শনাক্তকরণে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের অভাব রয়েছে। কৃষক সঠিকভাবে যন্ত্র পাচ্ছেন কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে না। কম্বাইন হারভেস্টার বারবার নষ্ট হওয়ায় কৃষকের বিনিয়োগ করা টাকা না ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।তালিকাভুক্ত না হওয়া অনেকে ভর্তুকিতে যন্ত্র সুবিধা পাচ্ছে। একই উপকারভোগীর একাধিকবার ভর্তুকিতে যন্ত্র পাওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টার কিনেছিলেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার কৃষক মেহেদী হাসান। তিনি জানান, যন্ত্রটি ধান ও গম কাটায় ব্যবহার করতেন। দুই মাস পর মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। সরবরাহকারী কোম্পানি বিক্রয়োত্তর সেবা দেয়নি। কোম্পানিকে যন্ত্র মেরামত করে দিতে বললে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যন্ত্র কিনে উল্টো যন্ত্রণায় পড়েছেন। মাঠে দালালদের চক্র, কোম্পানির চক্র।
পুঠিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেন, কৃষককে ভর্তুকির যন্ত্র দেওয়ার প্রলোভন দিচ্ছে কিছু প্রতারক। তাঁরা এ বিষয়ে কৃষকদের সতর্ক করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৩৪টি কোম্পানি এই প্রকল্পে আমদানি করা এবং দেশীয় যন্ত্র সরবরাহ করছে। এগুলোর মধ্যে ১৪টি কোম্পানি যন্ত্র আমদানি করে সরবরাহ করে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, যন্ত্র সরবরাহের জন্য আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর আমদানি করা যন্ত্রের ওপর মাঠপর্যায়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা, ২০টি ডিলার পয়েন্ট, ১০টি ওয়ার্কশপ ও ২৫ জন মেকানিক থাকার শর্ত থাকলেও তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির সব কটি নেই। এনবিআরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানি ২০২০ সালের আগে কোনো কৃষিযন্ত্র আমদানি করেনি। এরপরও সেগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কৃষকদের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর চুক্তিতে এক বছরের খুচরা যন্ত্রাংশের ওয়ারেন্টি এবং দুই বছর বিনা মূল্যে বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়ার উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ কোম্পানি তা মানছে না। খুচরা যন্ত্রাংশ কৃষককে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে এবং টাকা দিয়ে বিক্রয়োত্তর সেবা নিতে হচ্ছে।
এদিকে কৃষকের সঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার করা চুক্তিতে রয়েছে, তিন বছরের আগে ভর্তুকিতে কেনা যন্ত্র বিক্রি বা কোথাও হস্তান্তর করা যাবে না। তবে কৃষক কিস্তি না দেওয়ার অজুহাতে কোম্পানি যন্ত্র নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এমন অভিযোগ রয়েছে আবেদীন ইকুইপমেন্ট, বাংলামার্ক, আদী এন্টারপ্রাইজ, এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রীনল্যান্ড টেকনোলজিস, উত্তরণ ইঞ্জিনিয়ারিংসহ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে আবেদীন ইকুইপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমির হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভর্তুকির আওতায় আমাদের কোম্পানি প্রায় দুই হাজার কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করেছে। দু-একটির সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমরা কৃষকদের সেরা সেবা দিয়ে থাকি।’
বাংলামার্ক করপোরেশনের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, মাঠপর্যায়ে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। ফলে অনেক সময় শতভাগ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া প্রতিযোগিতার কারণে এক কোম্পানি অন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে।
আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর অনিয়ম নিয়ে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে। তবে নির্বাচিত কৃষক যন্ত্র কিনতে রসিদমূলে যে টাকা দিয়েছিলেন, তা-ও সমীক্ষাকালীন পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কৃষকের ভর্তুকির টাকা নিয়ে অনিয়মের তথ্য জানলে ব্যবস্থা নেব। ভর্তুকির বাইরে টাকা কৃষককে দিতে হয়। কৃষক অনেক সময় টাকা না দিয়ে কোম্পানিকে হয়রানি করে, তখন কোম্পানি তাদের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রকল্পটিতে ত্রিমুখী সিন্ডিকেট কাজ করছে। প্রকৃত কৃষককে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, যারা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কথা নয়, তারাই পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশ না থাকলে এটা কোনোভাবে সম্ভব নয়। সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছে তিন চক্র। এই তিন চক্রে আছেন প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি এবং স্থানীয় দালালেরা। খোঁজ নিয়ে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুষ, প্রকৃত কৃষকদের বদলে অন্যদের যন্ত্র পাওয়া, যন্ত্র নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র একাধিকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ নানা অভিযোগও উঠেছে এই প্রকল্পে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও প্রকল্পের বেশ কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে। তবে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, অনিয়মের কোনো তথ্য তাঁদের জানা নেই। কিছু কোম্পানির অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্ত করছি। সমস্যা নিরসনে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কিছু নির্দেশনাও দিয়েছি। আমরা চাই এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের কৃষিব্যবস্থার উন্নতি।’
কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে সরকার এই ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প নিয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে কৃষিযন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে হাওর ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা ৭০ শতাংশ এবং অন্য সব এলাকার কৃষকেরা ৫০ শতাংশ ভর্তুকি পাবেন।
কৃষকেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষক ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র পাচ্ছেন না। ঘুষ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরাও সমস্যায় পড়ছেন। যন্ত্র নষ্ট হলে কোম্পানি মেরামত করে দিচ্ছে না। যন্ত্রাংশের দাম রাখছে বেশি। যন্ত্রের দামও বেশি রাখার অভিযোগ আছে। আবার কেউ কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে যন্ত্র নিয়ে অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে কোম্পানি। আবার ভর্তুকি নিচ্ছে। কোম্পানিগুলোকে সহযোগিতা করছেন কিছু অসাধু কৃষি কর্মকর্তা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকের যন্ত্রের ভর্তুকির সুবিধা পকেটে ঢোকাতে সক্রিয় তিন চক্রের একটিতে আছেন অসাধু কৃষি কর্মকর্তারা। আরেকটি চক্র হচ্ছে যন্ত্র সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানি। তৃতীয় চক্রে আছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দালাল। যাঁরা মূলত ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সুপারিশে উপজেলা কর্মকর্তারা কৃষকের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ঘুষ হাতবদল হয় তাঁদের মাধ্যমে। অনেক সময় দালালেরা নিজেদের নামেই ভর্তুকিতে যন্ত্র কিনে বিক্রি করেন।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে টি সিডার (পাওয়ার টিলারের সঙ্গে বীজ বপন যন্ত্র) কেনেন আমির হোসেন সাজু। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার পশ্চিম সোনাদিয়ার বাসিন্দা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সরাসরি কৃষিকাজে জড়িত নন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আমির পরে যন্ত্রটি বিক্রি করে দেন। তবে নিজেকে কৃষক দাবি করে আমির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ট্রাক্টর পেয়েছি। যেভাবে বলছে সেভাবে দিয়েছি। কত টাকা ভর্তুকি দিয়েছে মনে নেই।’
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল বাছেদ সবুজ বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে দু-একজন পেতে পারেন। তবে আমরা অবহিত না।’কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার কৃষক আনিসুর রহমান অভিযোগ করেছেন যন্ত্রের দাম বেশি নেওয়ার। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আবেদীন ইকুইপমেন্ট লিমিটেড থেকে বেশি দামে কেনা কম্বাইন হারভেস্টারের ইঞ্জিন তিন মাসেই নষ্ট হয়ে গেছে। চুক্তিতে কোম্পানির মেরামতের কথা থাকলেও দেয়নি। তাঁদের উপজেলায় ওই কোম্পানি পাঁচটি কৃষিযন্ত্র বিক্রি করেছে। এর তিনটি নিয়ে গিয়ে আবার অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা যন্ত্র ভালোভাবে যাচাই করেননি। মাঝখানে প্রতারণায় পড়েছেন কৃষকেরা।
গত ৩০ জুন প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারিগরি কমিটির নির্দেশনা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাব মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বাজারদর যাচাই না করে উচ্চ দরে যন্ত্র কেনা, নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহ করা হলেও জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটিতে উপকারভোগী শনাক্তকরণে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের অভাব রয়েছে। কৃষক সঠিকভাবে যন্ত্র পাচ্ছেন কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে না। কম্বাইন হারভেস্টার বারবার নষ্ট হওয়ায় কৃষকের বিনিয়োগ করা টাকা না ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।তালিকাভুক্ত না হওয়া অনেকে ভর্তুকিতে যন্ত্র সুবিধা পাচ্ছে। একই উপকারভোগীর একাধিকবার ভর্তুকিতে যন্ত্র পাওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টার কিনেছিলেন রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার কৃষক মেহেদী হাসান। তিনি জানান, যন্ত্রটি ধান ও গম কাটায় ব্যবহার করতেন। দুই মাস পর মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। সরবরাহকারী কোম্পানি বিক্রয়োত্তর সেবা দেয়নি। কোম্পানিকে যন্ত্র মেরামত করে দিতে বললে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যন্ত্র কিনে উল্টো যন্ত্রণায় পড়েছেন। মাঠে দালালদের চক্র, কোম্পানির চক্র।
পুঠিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেন, কৃষককে ভর্তুকির যন্ত্র দেওয়ার প্রলোভন দিচ্ছে কিছু প্রতারক। তাঁরা এ বিষয়ে কৃষকদের সতর্ক করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৩৪টি কোম্পানি এই প্রকল্পে আমদানি করা এবং দেশীয় যন্ত্র সরবরাহ করছে। এগুলোর মধ্যে ১৪টি কোম্পানি যন্ত্র আমদানি করে সরবরাহ করে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, যন্ত্র সরবরাহের জন্য আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর আমদানি করা যন্ত্রের ওপর মাঠপর্যায়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা, ২০টি ডিলার পয়েন্ট, ১০টি ওয়ার্কশপ ও ২৫ জন মেকানিক থাকার শর্ত থাকলেও তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির সব কটি নেই। এনবিআরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানি ২০২০ সালের আগে কোনো কৃষিযন্ত্র আমদানি করেনি। এরপরও সেগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কৃষকদের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর চুক্তিতে এক বছরের খুচরা যন্ত্রাংশের ওয়ারেন্টি এবং দুই বছর বিনা মূল্যে বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়ার উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ কোম্পানি তা মানছে না। খুচরা যন্ত্রাংশ কৃষককে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে এবং টাকা দিয়ে বিক্রয়োত্তর সেবা নিতে হচ্ছে।
এদিকে কৃষকের সঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার করা চুক্তিতে রয়েছে, তিন বছরের আগে ভর্তুকিতে কেনা যন্ত্র বিক্রি বা কোথাও হস্তান্তর করা যাবে না। তবে কৃষক কিস্তি না দেওয়ার অজুহাতে কোম্পানি যন্ত্র নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এমন অভিযোগ রয়েছে আবেদীন ইকুইপমেন্ট, বাংলামার্ক, আদী এন্টারপ্রাইজ, এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রীনল্যান্ড টেকনোলজিস, উত্তরণ ইঞ্জিনিয়ারিংসহ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে।
অভিযোগের বিষয়ে আবেদীন ইকুইপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমির হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভর্তুকির আওতায় আমাদের কোম্পানি প্রায় দুই হাজার কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করেছে। দু-একটির সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমরা কৃষকদের সেরা সেবা দিয়ে থাকি।’
বাংলামার্ক করপোরেশনের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, মাঠপর্যায়ে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। ফলে অনেক সময় শতভাগ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া প্রতিযোগিতার কারণে এক কোম্পানি অন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে।
আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর অনিয়ম নিয়ে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে। তবে নির্বাচিত কৃষক যন্ত্র কিনতে রসিদমূলে যে টাকা দিয়েছিলেন, তা-ও সমীক্ষাকালীন পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কৃষকের ভর্তুকির টাকা নিয়ে অনিয়মের তথ্য জানলে ব্যবস্থা নেব। ভর্তুকির বাইরে টাকা কৃষককে দিতে হয়। কৃষক অনেক সময় টাকা না দিয়ে কোম্পানিকে হয়রানি করে, তখন কোম্পানি তাদের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রকল্পটিতে ত্রিমুখী সিন্ডিকেট কাজ করছে। প্রকৃত কৃষককে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, যারা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কথা নয়, তারাই পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশ না থাকলে এটা কোনোভাবে সম্ভব নয়। সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ দিন আগেগাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪দেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২০ নভেম্বর ২০২৪