Ajker Patrika

অনিরাপদ নারীর জীবন

মন্টি বৈষ্ণব,সাংবাদিক
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৪: ৪৮
অনিরাপদ নারীর জীবন

অদ্ভুত এক সময়ে বসবাস করছি আমরা। চারদিকে শুধু ভয় আর আতঙ্ক। প্রতিটা দিন নিজের জীবন হাতের মুঠোয় করে ঘর থেকে রাস্তায় বের হচ্ছে মানুষ। কখন কী যে হবে, তা কেউ বলতে পারবে না। মানুষের একমুহূর্তের বেঁচে থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে দিন শেষে বেঁচেবর্তে আবার ঘরে ফিরে আসবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এভাবে চলছে আমাদের জীবন।

দেশের নারীদের জীবন আরও বেশি অনিরাপদ। প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁদের জীবন কাটে ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে। দেশে সমতল আর পাহাড়ে প্রায়ই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারী। ধর্ষণের শিকার নারীর কান্নায় বাতাস হয়ে উঠছে ভারী। হয়তো সামান্য কিছু ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ নির্যাতনের ঘটনা লোকলজ্জার ভয়ে আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পেছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মানুষদের সম্পৃক্ততার খবর বেশি পাওয়া যায়। ক্ষমতার দাপটে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণে অপরাধীদের দাপট কমছে না। শিশু, বৃদ্ধ ও অন্তঃসত্ত্বাসহ সব বয়সের নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। মক্তবে পড়তে গিয়ে, রাস্তায়, চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে, সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে, ধানখেত, পাটখেতে, রাতের অন্ধকারে ঘরের বেড়া কেটে ঘরে ঢুকে, চলন্ত বাসে নারীরা ধর্ষণের শিকার হন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর করা হচ্ছে হত্যা।

ধর্ষণের শিকার নারীর কান্না রাষ্ট্রের কানে সেভাবে সব সময় পৌঁছায় না। একটি ধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে খবরের কাগজে জায়গা করে নিচ্ছে আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা। এই ভয়াবহতার শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারে না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ২৩৫ জন। এর মধ্যে ৬২৯ জন কন্যাশিশুসহ ১ হাজার ১৮ জন ধর্ষণের শিকার, ৬২ জন কন্যাশিশুসহ ১৭৯ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২২ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৩১ জন, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। এ ছাড়া ১৪ জন কন্যাশিশুসহ ৩৩ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। ১৫৩ জন কন্যাশিশুসহ নারী অপহরণ হয়েছে ১৮০ জন। একজন কন্যাশিশুসহ যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। ৫৮ জন কন্যাশিশুসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। বিভিন্ন কারণে ১১৪ জন কন্যাশিশুসহ ৪৪৪ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে, ১৯ জন কন্যাশিশুসহ ৮৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ২৩ জন কন্যাশিশুসহ ৬৩ জন সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন। এক একটা নির্যাতনের ঘটনায় এক একটা পরিবারে নেমে আসছে হতাশা ও চরম দুঃখবোধ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৪০ জন। নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৭২ এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১০ নারী।

নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরবেন–এই নিশ্চয়তা রাষ্ট্র এখনো দিতে পারছে না। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমা হয়ে আছে বহুদিনের বৈষম্য। যত দিন পর্যন্ত এ বৈষম্যের অবসান না ঘটবে, তত দিন পর্যন্ত নারী নির্যাতনেরও অবসান ঘটবে না। আর বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত