Ajker Patrika

রোজার আগে বাজার গরম

ফারুক মেহেদী ও আয়নাল হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ০৯: ১৮
রোজার আগে বাজার গরম

করোনার ধকল এখনো কাটেনি। এর মধ্যেও টানাটানির সংসারে বাড়তি খরচের চাপে অনেকটাই বেসামাল মধ্যবিত্তের দিনযাপন। হেঁশেল চালু রাখতে কেউ কেউ জমানো টাকা শেষ করে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্জ করেছেন। আয় তো বাড়েইনি, উল্টো প্রতিটি জিনিসপত্রের বাড়তি দাম; বাসাভাড়া, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের বাড়তি বিল, বাচ্চার স্কুল-কলেজের খরচসহ প্রতিদিনের প্রতিটি পণ্য ও সেবার পেছনে অন্যায্য খরচের বোঝা বহন করে প্রায় দিশেহারা স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ।

সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় কয়েকটি পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকলেও এখনো অনেক পণ্যের দাম কমেনি। আর সামনে রোজাকে ঘিরে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়ার আতঙ্ক মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববাজার, স্থানীয়ভাবে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ পণ্যের দামই বাড়তির দিকে। রোজায় জিনিসপত্রের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।

রাজধানীর মিরপুর-১-এর চিড়িয়াখানা রোডের পাশে একটি দুই রুমের বাসায় ভাড়া থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল হাসান। এক ছেলে, এক মেয়ের সংসারে তাঁরা স্বামী-স্ত্রীসহ চারজন। এখন বেতন অনিয়মিত। দুই বাচ্চা স্কুলে যায়। আজকের পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে জানান, বাসাভাড়া দেওয়ার পর হাতে যে টাকা থাকে, তা দিয়ে চাল, ডাল ও অন্যান্য দরকারি নিত্যপণ্য কিনতেই শেষ। বেতনের টাকায় চলে না বলে বাধ্য হয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বেশ কয়েক দফায় ধারকর্জ নিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুতের দামও নাকি বাড়বে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, দিনমজুর, রিকশাচালক, কারখানার কর্মী, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে শুধু একজন হাসানই নয়, এ রকম অসংখ্য হাসানের নিত্যদিনের কঠিন সংগ্রামের ঘটনা জানা যায়। যাঁরা কোনো দিন টিসিবির লাইনে দাঁড়াননি, তাঁদের অনেকেই এখন টিসিবির ট্রাকের সামনে দীর্ঘসময় ধরে লাইন দিচ্ছেন। কেউবা সরকারের ভর্তুকি দামে কয়েকটি নিত্যপণ্য কিনে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

নিত্যপণ্যের দামের উত্তাপ সরকারের শীর্ষ মহল পর্যন্ত অবগত। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে দেশেও দাম বাড়ছে বলে এক সভায় জানিয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানিয়েছেন যে জিনিসপত্রের দাম যে বেড়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সারা বিশ্বেই তা বেড়েছে।

এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। মানে হলো গত বছর ফেব্রুয়ারিতে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, তা এখন ১০৬ টাকা ১৭ পয়সায় কিনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম আগেই অনেক বেড়েছে। আর কত বাড়বে? বাড়ার তো জায়গা নাই। তারপরও কিছু বাড়বে। এটা আমার ধারণা, ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।’

জানা যায়, বিশ্ববাজারে বেশ কয়েক মাস ধরেই জ্বালানি তেলের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব, ভোজ্যতেল, চিনি, গমসহ দরকারি সব নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন শিপিং খরচ স্থানীয় বাজারেও উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশীয় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর অতিমুনাফার লোভ। এর ফলে আমদানিনির্ভর পণ্যের বাড়তি দামের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের ফলে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডিও জানিয়েছে, বাজারে একটি অসাধু চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। তা রোধ করতে সরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করলেও বাজারে এর কার্যকর প্রভাব সামান্যই দেখা গেছে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হলে পণ্যটির ওপর থেকে সরকার প্রায় ৩০ শতাংশ শুল্ক-কর-ভ্যাট বাবদ রাজস্ব ছাড় দিলেও বাজারে সে তুলনায় দাম কমার প্রবণতা কম। এক সপ্তাহে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে মাত্র ৮-৯ টাকার মতো। চিনির দাম সহনীয় রাখতে এর সম্পূরক শুল্কও কমানো হয়। অথচ এর দামও বাড়ার প্রবণতায় রয়েছে। একমাত্র পেঁয়াজের দাম এখন সহনীয় রয়েছে। কৃষিসচিব মো. ছায়েদুল হক গতকাল সচিবালয়ে এক সভায় জানান, পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তৈরি হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২১ মার্চের বিশ্ব বাজারদরের সঙ্গে এর আগের এক সপ্তাহের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায় কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়তির মধ্যে আছে। যেমন গমের কেজি ২৫ দশমিক ৪৯ টাকা থেকে ২১ মার্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ দশমিক ৪৫ টাকা। পরিশোধিত চিনির দাম ৪১ দশমিক ২৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৩২ টাকা। অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৩৭ দশমিক ২৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৫ দশমিক ৮৬ টাকা।

সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির প্রতিদিনের বাজারদর নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশি আদার দাম এক সপ্তাহে কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। দেশি মুরগির দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়েছে। গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। খোলা ময়দার দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা। আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা।

গতকাল আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে রাজধানীর কয়েকটি বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় সংশ্লিষ্টরা জানান, রোজায় ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, খেজুর, ছোলা, বেগুন, শসা, লেবু, গরু ও খাসির মাংসের চাহিদা বেশি থাকে। সম্প্রতি মাংসের দামেও রেকর্ড গড়েছে।

বাজারে এখনো ভোজ্যতেল সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বাজারগুলোতে খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। অথচ সরকার নির্ধারিত দাম ১৩৬ টাকা। পাম তেল ১৩১-১৪২ টাকা, এক লিটারের বোতল ১৬০-১৬৫ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৭৪০-৭৬০ টাকা। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়, ছোলা ৭০-৭৫ টাকায়। মসুর ডাল মোটা দানা ৯৫-১০০ টাকা, সরু দানার ১১৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গরুর মাংস ৬৫০-৭০০ টাকা ও খাসির মাংস ৮৫০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, পাইকারিতে এই মুহূর্তে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম আছে। তবে পাইকারির চেয়ে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি পণ্য ২০-২৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র আড়তদার সমিতির সভাপতি এ টি এম ফারুক বলেন, রোজা শুরুর দুই দিন আগে থেকে মানুষ একসঙ্গে বাজারে আসে। আর রোজার পাঁচ দিন পর্যন্ত পণ্যের ওপর বেশি চাপ থাকে। সে কারণে দাম কিছুটা বাড়ে।

কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব গোলাম রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রোজায় সুযোগসন্ধানী একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ অতিমুনাফার চেষ্টা করে। এটা নজরদারি বাড়িয়ে রোধ করতে হবে। ভোক্তাদেরও পরিমিত কেনাকাটা করা উচিত। আর সরকারের দিক থেকে বড় কাজ হলো বাজারে যাতে সরবরাহব্যবস্থা কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত