Ajker Patrika

আলাপ আছে সংলাপ নেই

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ১৯
আলাপ আছে সংলাপ নেই

সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের গতিপ্রবাহ নৃশংসতা, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ এখন প্রতিটি পরিবারেরই আলাপের বিষয়। চায়ের দোকানে, বাসে যেকোনো সভা-সমাবেশে একই আলাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও মৌন মিছিল করে গিয়ে একই কথা বলছেন। আবার এর মধ্যে ১২ দিনে ১০ হাজার মানুষকে বন্দী করা হয়েছে এবং বন্দীর কার্যক্রম চলছে। এটাও জানা গেল, আদালতে একজনেরও জামিন হয়নি। একদিকে মানুষ আলাপ-আলোচনা করছে, অন্যদিকে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করেই যাচ্ছে। আদালত চত্বরে অনেক অসহায় নারী, প্রবীণ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাঁদের স্বামী-সন্তানদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হাজার হাজার লোককে কারাগারে রাখা এবং তাদের মামলার কাগজপত্রাদি তৈরি করাও পুলিশের জন্য একটা বিরাট বিষয়। আদালতকেও দেখতে হবে সত্যিই এরা সন্ত্রাসী কি না, তার জন্য প্রচুর প্রমাণ প্রয়োজন।

আজ আলাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মিডিয়ায় মুহুর্মুহু প্রচারিত ডিবির কার্যালয়—সমন্বয়কদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের মধ্যাহ্নভোজ। যাকে হাইকোর্ট জাতির প্রতি মশকরা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সরকারপক্ষ এ রকম একটি বিষয়কে পুলিশের হাতে ছেড়ে দিল বা কেন? দলের মধ্যে এত মন্ত্রী, এত রাজনীতিবিদ থাকার পরেও এর রাজনৈতিক সমাধান না করে ছেড়ে দিলেন পুলিশের হাতে! পুলিশ কোনো রাজনৈতিক সংলাপ তৈরি করে না, সেটা তাদের কাজও নয়। তাদের কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং প্রয়োজনে কোনো সন্ত্রাসের কারণ নির্ণয় করতে গোয়েন্দা পুলিশকে ব্যবহার করা। 

সত্যিকার অর্থে গোয়েন্দা পুলিশ একটি গোপন বাহিনী। বর্তমানে এটি এতই উন্মুক্ত যে সব সমস্যার সমাধান ওখানেই যেন হচ্ছে। মানুষ আলাপ-আলোচনা করছে, প্রতিটি আলোচনার মধ্যেই মৌলিক উপাদান আছে। সবার কাছেই এমন সব তথ্য এবং ছবি আছে, যা আমাদের অজানা। জনগণের এই তথ্য ও ছবি পুলিশের আমলে নেওয়ার কথা নয়। কারণ তাদেরই নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে।

আমাদের তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সব সময়ই সরকারবিরোধী। সরকারের ন্যায্য-অন্যায্য সব কথাবার্তাই তারা আলাপের অংশ হিসেবে ধরে নেয়। সরকারের ভালো কাজও তারা সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে। এটা সেই ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের প্রেসনোটে নিহতের সংখ্যা, তা শুধু আন্দোলনে নয়—লঞ্চ দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনা—কেউ বিশ্বাস করে না। এই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির বিষয়টির জন্য কোনো প্রক্রিয়া কোনোকালেই তৈরি হয়নি। ফলে সরকার একধরনের আলাপ করে, জনগণ অন্য ধরনের আলাপ করে। এই দুইয়ের মাঝে সংলাপ কখনোই তৈরি হয়নি।

রিকশাওয়ালা, সিএনজির ড্রাইভার, ট্যাক্সির ড্রাইভার, চা-ওয়ালা প্রত্যেকেরই আলাপ আছে এবং সেই আলাপটি স্বভাবতই সরকারবিরোধী। ক্ষমতাসীন দলের বঞ্চিতরা এই আলাপগুলো আরও প্রমাণ ও তথ্য নিয়ে ছোট ছোট আড্ডায় ক্ষোভের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকে। আমি নাটক করি বলে সংলাপ শব্দটি ব্যবহার করছি। কারণ, সাধারণত নায়ক এবং প্রতি নায়কের মধ্যে সংলাপ না হলে নাটক দাঁড়ায় না। জীবনের সঙ্গে নাটকের এখানেই সম্পর্ক। জীবনকেও সংলাপমুখর হতে হয়। সেটা হোক পরিবারে, বিদ্যালয়ে বা সামাজিক কোনো আসরে। ছাত্রদের কাছে বিতর্ক প্রতিযোগিতা এখনো খুব জনপ্রিয়। অকাট্ট যুক্তি দিয়ে তারা এই বিতর্কগুলো করে থাকে। শিক্ষার উদ্দেশ্যও তা-ই। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তর্ক-বিতর্কই মানুষকে মহত্ত্বের সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেত। যুক্তি, তর্ক এবং সক্ষমতা—এ বিষয়গুলো তখন থেকেই মুখ্য ছিল।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংলাপ একেবারেই উবে গেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্পর্কের প্রবল অবনতি ঘটেছে এবং সেই অবনতির একটা বড় রূপ আমরা দেখতে পাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে। রাজনীতিবিদদের এই দখল শব্দটি ছাত্রদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। শাসক দলের ছাত্র-যুব সংগঠনগুলো বহু বছর ধরে তার চর্চা করে আসছে। এগুলো উপেক্ষা করা রাজনীতিবিদদের যে একেবারে উচিত হয়নি তা এবার প্রমাণিত হলো। দখলের মধ্যে কোনো সংলাপ থাকে না, থাকে শুধু নির্দেশ।

গণতন্ত্র একটি বহুত্ববাদী চিন্তার ফসল। একটি দেশে সব বর্গের জাতিগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা প্রতিফলন ঘটে রাজনীতিতে। সেই রাজনীতি যদি সংলাপকে পরিহার করে তাহলে যে সংঘাত অনিবার্য, সে অবস্থাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমার দশম শ্রেণির কোনো এক বন্ধু ফোনে চিৎকার করে বলছিল, ‘আমার বন্ধু মারা গেছে, তুমি কী করবে?’ আমি অসহায়, আমার কিছুই করার নেই দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া। ঘটনার সেই শুরু, জনতার পুঞ্জীভূত আক্রোশ এবং আমার বন্ধুটি আর বসে থাকেনি, সে আক্রোশে গিয়ে যোগ দিয়েছে। তাতেও কোনো সংলাপ হলো না। মাঝখান থেকে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে ধ্বংসলীলা শুরু হলো। 

এ দেশে দুষ্কৃতকারীর অভাব নেই, যে সেবা সংস্থাগুলো দলমত-নির্বিশেষে সেবা দিয়ে আসছে—যেমন মেট্রোরেল, সেখানে আঘাত করে বসল। নির্বিঘ্নে যেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফার্মগেট থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়া যেত, সেই অসাধারণ নির্মাণটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো। এগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। আগুন ধরানো, ভাঙচুর করার জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে। সেগুলো সংগ্রহ করে তারা দীর্ঘ সময় ধরে এই নাশকতা চালিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, তাদের ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। নিরাপত্তারক্ষীরা অপ্রতুল, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে পারেনি। তাদের সাধ্যও ছিল না। তারা পদ্মা ও যমুনা সেতুকেও আক্রমণ করত, কিন্তু সেখানকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কারণে তারা তা পারেনি। 

আজ সরকার নানা ব্যবস্থার নির্দেশ দিচ্ছে, অথচ বহু আগেই এই ব্যবস্থাগুলোর কথা বলা হয়েছে। জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই নানা ধরনের মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিপ্পান্ন বছর কেটে গেল! সরকার যেকোনো নাশকতামূলক কাজের জন্য বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু আরও কিছু পক্ষ যে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছে, সে কথা কখনো আসেনি। তাদেরও খুঁজে বের করা দরকার। এই দেশের ১৮ কোটি মানুষ, দীর্ঘ সীমান্ত পথে কত ধরনের মানুষের আনাগোনা—সেটাও তো দেখার বিষয়।

আজ সরকার একটি আলাপের জায়গা চিহ্নিত করতে পেরেছে, সেটা হচ্ছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেট শত সহস্র আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। কিন্তু এটাকে বন্ধ করে কোনো সমাধান হবে না। ইন্টারনেটের আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তার চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত দিতে হবে সরকারকে। নতুন সংলাপের আয়োজন করতে হবে। আলাপ চলছে, তার মধ্য থেকেই সংলাপের সূচনা করতে হবে। সেই বুদ্ধিমত্তা এবং নতুন কথা অপর পক্ষকে জানতে হবে। বর্তমান সরকার ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলেও তারা ক্ষমতাকেই তাদের প্রধান শক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্য সংলাপের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনীকে বেছে নিয়েছে। তাদের যে রাজনৈতিক শক্তি—জনগণকে কাছে নিয়ে আসা, তার কোনো উদ্যোগ হচ্ছে না।

সংলাপ দীর্ঘস্থায়ী, তার প্রভাব সমাজে বহুদিন থেকে যায়; কিন্তু একপেশে আলাপ-আলোচনা একটা নিরর্থক ব্যাপারে পরিণত হয়। প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংলাপে যাব না—এটি একধরনের একদেশদর্শিতার প্রতিফলন। বিবদমান দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ না করলে সমাজ থিতু হবে না। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রয়োজনে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে। কারণ জনগণের নিজস্ব আলাপ-আলোচনাও আছে। বাঙালির মৌলিক চিন্তা অসীম। একজন রিকশাওয়ালাও আমাকে অর্থনীতির শিক্ষা দেয়, কেন সে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিদিন ধারণা দিয়ে আসছে আমাদের শিশু থেকে শুরু করে যুবকদের। সেখানে আমাদের প্রাচীন ভাবনাগুলো কি ধোপে টিকবে? বরং আমরা শেখার চেষ্টা করি—ওরা কী বলতে চাইছে এবং এর সমাধান কী? শেখা কোনো খারাপ বিষয় নয়, যেকোনো বয়সে আমরা শিখতে পারি। শেখার প্রথম মাধ্যম হিসেবে আমরা চেষ্টা করি দেশের ইতিবাচক শক্তির সঙ্গে একটা সংলাপ সৃষ্টি করার।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১০০ বছর পর জানা গেল ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রত্যঙ্গটি নারীর প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেমকে অব্যাহতি

ঘন ঘন নাক খুঁটিয়ে স্মৃতিভ্রংশ ডেকে আনছেন না তো!

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত