Ajker Patrika

কার হাতে যাচ্ছে গাজীপুর

তাসনিম মহসিন, গাজীপুর থেকে ফিরে
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ১১: ৩৪
কার হাতে যাচ্ছে গাজীপুর

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের হারিকেন এলাকায় সদ্য বহিষ্কার হওয়া আওয়ামী লীগের গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের বাসা। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রও। দলীয় পদ হারানোর পর এবার আলোচনা চলছে তিনি মেয়র পদও হারাবেন কি না।

এরই মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় কেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যোগ্যতা তুলে ধরায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কাউন্সিলররা। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার জন্য কাউন্সিলর মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও কাউন্সিলর আবদুল্লাহ আল মামুন মণ্ডলের নাম তাঁদের সমর্থকদের থেকে বেশ জোরেশোরেই আসছে।

ভারপ্রাপ্ত মেয়র হতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরন। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার জন্য তদবির শুরু করেছেন। ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার দৌড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আসাদুর রহমান কিরনকে এগিয়ে রাখছেন। কারণ এর আগে তাঁর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

কে হবেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। নাকি আবারও নির্বাচন দিতে হবে, সেই বিতর্ক শুরু হয়েছে গাজীপুরে। কারণ মেয়রের প্যানেল থেকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করে থাকে। তবে গত ৩ বছরেও মেয়র প্যানেল নির্বাচন দেননি বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এখন সরকার থেকে যদি মেয়র প্যানেল ঠিক করে দেয়, তবে নতুন করে আর নির্বাচনের প্রয়োজন পড়বে না।

গাজীপুরের আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, গাজীপুর হচ্ছে টাকার খনি। যে পরিমাণ শিল্প-কলকারখানা এখানে রয়েছে, প্রতি মাসে যে পরিমাণ চাঁদা এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়, তার ভাগ কেন্দ্র পর্যন্ত যায়। জাহাঙ্গীর কেন্দ্রের এক উচ্চপর্যায়ের নেতাকে ৪ কোটি টাকার গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। তারপরই জাহাঙ্গীরের ওপর সুনজর পড়েছে। ফলে গাজীপুরের সাম্রাজ্য তাঁর হাতেই যাবে, যিনি কেন্দ্রকে খুশি রাখতে পারবেন।

উন্নয়নের ছদ্মবেশে ব্যবসা

বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকা ২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন হওয়া গাজীপুরের আয়তন ৩৩০ বর্গকিলোমিটার। ঢাকা শহরের চেয়েও যা বড়। তবে গাজীপুরে নেই কোনো নগরীর ছোঁয়া। গাজীপুরবাসী উন্নয়ন বলতে বোঝে শুধু রাস্তা তৈরি। আর এ রাস্তা তৈরি পুরো গাজীপুরবাসীর আতঙ্কের নাম।

রাস্তা তৈরির নামে প্রায় ৩০ হাজার গাজীপুরবাসীকে পড়তে হয়েছে বিপদে। রাস্তা তৈরির জন্য করা হয়েছে জমির অধিগ্রহণ। তবে সেই অধিগ্রহণে মানা হয়নি কোনো নিয়মনীতি, অভিযোগ একাধিক ভুক্তভোগীর। রাস্তার কাজে ভূমি অধিগ্রহণ করেও মোটা অঙ্কের আয় করার সুযোগ নেন জাহাঙ্গীর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। অধিগ্রহণের নামে জমি নিয়ে কোনো ভূমির মালিককেই ন্যায্যমূল্য দেননি জাহাঙ্গীর। উল্টো রাস্তার কাজ দেখিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

মেয়র জাহাঙ্গীরের হারিকেন এলাকায় যে বাড়ি রয়েছে, সেটির এক অংশ অন্যের জমি দখল করে তৈরি করা বলে অভিযোগ করেছেন কাউন্সিলর আবদুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, মেয়র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ির পাশে থাকা দোকানটি ভেঙে সেখানে গেট তৈরি করা হয়। এ দোকান ও জমির মালিক ছিলেন দুই ভাই মো. সাইফুল ইসলাম ও কফিল উদ্দিন কফু।

স্থানীয় জনগণ ও সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম মেয়র হওয়ার পর শুরু করেন ইটের ব্যবসা। বছরের যে সময়ে ইটের দাম ও চাহিদা কম থাকত, তখন তিনি বিপুল অঙ্কের ইট কিনে রাখতেন। আর সেই ইট সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারদের কাছে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতেন। তাই রাস্তা তৈরির দিকে নজর ছিল তাঁর।

ইতিমধ্যে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (অঞ্চল-৭) নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে (৫০) পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এলাকাবাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, এ প্রকৌশলীকে দিয়ে এক রাস্তা তিনবার তৈরি হয়েছে দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যখন দেলোয়ার হোসেন তাতে সই করতে অস্বীকার করেন, তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়। এতে মেয়রের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন সবাই।

জাহাঙ্গীরের উত্থান হয়েছিল বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার হাত ধরে। সেখান থেকে ঝুট ব্যবসা দিয়ে শুরু। পরে আর কখনো পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গাজীপুরের ঝুট ব্যবসার ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন মেয়র। মেয়র হওয়ার আগে জাহাঙ্গীর আলম এনটিকেসি গার্মেন্টসের সঙ্গে ঝুটের ব্যবসা করতেন। মেয়র হওয়ার পর এ কারখানা থেকে ঝুটসহ কাপড়ের রোল, তৈরি পোশাক জোর করে নিয়ে যেতেন। পরে এর মালিককে বাধ্য করেন কারখানা তাঁর কাছে হস্তান্তরের জন্য।

শুধু ব্যবসা দখল নয়, চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে বা ঝুট ব্যবসা তাঁর অনুকূলে না এলে ট্রেড লাইসেন্স পুনঃনবায়ন না করাসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এমনকি ব্যবসায়ীদের রপ্তানির জন্য একটি লাইসেন্স গাজীপুর চেম্বার অব কমার্স থেকে নিতে হতো। সেখানেও ভাগ বসানোর জন্য তৈরি করেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স।

এ ছাড়া পুরোনো ঠিকাদারদের লাইসেন্স নবায়ন না করে তিনি নিজ পছন্দের ঠিকাদারদের লাইসেন্স দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। স্বেচ্ছাসেবকের নামে রাস্তায় নিজ লাঠিয়াল বাহিনীকে নামিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অটোরিকশা স্ট্যান্ডের নামে চাঁদা তোলা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করাসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে মেয়র জাহাঙ্গীরের নামে।

এত অভিযোগ আগে দেওয়া হলেও আমলে নেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় আওয়ামী লীগের পদ হারাতে হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমকে। এখন মেয়র পদ থাকা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সব অভিযোগ মিথ্যা বলে আজকের পত্রিকার কাছে দাবি করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ সিটি করপোরেশন করে না। এটি করেন জেলা প্রশাসক। ভুক্তভোগীরা যদি অর্থ না পান, সেটি জেলা প্রশাসকের দায়ভার। আমার বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ নেই। আমার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তাহলে এত দিন আপনারা সাংবাদিকেরা কোথায় ছিলেন?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত