Ajker Patrika

তেলের ধাক্কায় হতবাক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২২, ০৮: ৩৫
Thumbnail image

হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর ঘোষণায় সবাই ধাক্কা খেয়েছে। একেবারে দিন আনে দিন খায় মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ সবাই আছেন এই তালিকায়। সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে মূল্য বাড়ালেও বিশেষজ্ঞরা এর সময় ও পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পরিবহন, কৃষি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামসহ সমাজের সর্বত্র পড়বে। দেশের অর্থনীতি করোনার ভয়াবহতা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে বিপদের মুখে পড়ল। আর এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন আয়ের মানুষ।

সরকার গত শুক্রবার রাত ১২টা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে। মাঝরাতেই এক ধাক্কায় ৮০ টাকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, ৮৬ টাকার পেট্রলের দাম ১৩০ এবং ৮৯ টাকার অকটেন ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি তেলে সরকারকে কোনো ভর্তুকি দিতে হবে না। বরং লাভই থাকবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সরকারের লাভের পরিমাণ আরও বাড়বে।

প্রতিমন্ত্রী যা বললেন

নসরুল হামিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, দাম বাড়ার কারণে বিপিসির কোনো সাশ্রয় হবে না। বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে তুলনা করলে ডিজেলের খরচ পড়ে ১২২ টাকা। আমরা বাড়িয়ে করেছি ১১৪ টাকা। সুতরাং ডিজেলে লোকসান থেকেই যাবে। ভবিষ্যতে তেল আমদানি করতে গেলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইএমএফের কোনো চাপ ছিল কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর কোনো চাপ ছিল না।’

ডিজেলে লাভই থাকবে

দেশে যত পরিমাণ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় তার ৭৩ শতাংশই ডিজেল। গণপরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে।

আর ডিজেলের জন্য সরকারের ব্যয় হয় সর্বাধিক। দাম বাড়ানোর পরেও এই ডিজেলে প্রতি লিটারে ৮ টাকা করে ভর্তুকি দিতে হবে বলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানান।

তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ আগস্ট প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ১৩৮ ডলার। ৪ আগস্টে তা কমে ১৩৪ ডলার হয়। ডলারের সরকারি বিনিময় হার ৯৪ দশমিক ৭০ টাকা হিসাবে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৩৪ ধরলেও বাংলাদেশে এক লিটার ডিজেলের দাম পড়ে ৮০ টাকার মতো। বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমানে ডিজেলের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে লিটার প্রতি ভ্যাট ও ট্যাক্স ২৫ টাকা বাদ দিয়েও ৫-৬ টাকা লাভ থাকবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম পড়তে শুরু করেছে। সামনে বিশ্ববাজারে ডিজেল উৎপাদনকারী বেশ কিছু রিফাইনারি উৎপাদনে আসবে। তখন ডিজেলের মূল্য আরও কমবে।

পেট্রল ও অকটেনে বিপুল মুনাফা বিপিসির

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ একটি গেজেট প্রকাশ করে। ওই গেজেট অনুসারে বিপিসি মূল্য সংযোজন কর দেওয়ার পর ৪৯ টাকা লিটার দরে পেট্রল কেনে। অন্যদিকে অকটেন কেনে ৫৫ টাকা লিটারে দরে। আর কেরোসিন কেনে প্রতি লিটার ৪৮ টাকা দরে। গত শুক্রবার নতুন নির্ধারিত মূল্য তালিকা অনুযায়ী, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের কেনা ও বিক্রির দামে পার্থক্য বিপুল। এই হিসাবে পেট্রল বিক্রি করে ৮১ টাকা, অকটেনে ৮০ টাকা এবং কেরোসিনে ৬৬ টাকা লাভ করবে বিপিসি। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, অকটেন ও পেট্রলের চাহিদা দেশে উৎপাদিত গ্যাসের উপজাত থেকে মেটানো হয়।

মার খাওয়া ছাড়া গতি নাই

গতকাল রাজধানীর মিরপুর-১ এর রাইনখোলা এলাকায় কথা হয় বাস ড্রাইভার আলামিনের সঙ্গে। ত্যক্ত-বিরক্ত আলামিন বলেন, বাস আর চালানো যাবে না। এত বেশি দামে ডিজেল কিনে বাস চালিয়ে বাড়তি ভাড়া চেয়ে মানুষের মার খাওয়া ছাড়া গতি নেই। পাশেই চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনকেও একই সুরে কথা বলতে শোনা যায়। তাঁরা স্বল্প আয়ের মানুষ। গতকাল যত মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে, প্রায় সবারই এক সুরে বলেছেন—এটা কেমন হলো! এক সঙ্গে এত দাম বাড়লে সবকিছুর দামে তো নৈরাজ্য শুরু হবে। তখন খেয়েপরে থাকাই তো কঠিন হয়ে যাবে। অথচ সরকারের উচিত হলো মানুষের কষ্ট কমিয়ে স্বস্তি দেওয়া। তা না করে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে উল্টো মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর বিষয়টি ভার্চুয়াল জগতেও রীতিমতো সমালোচনা আর ক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মন্তব্য, কার্টুন, ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।

দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমছে, তাই এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত। তিনি বলেন, ‘একেবারেই ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোরও কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। এখন যে পরিমাণ দাম বেড়েছে, আর আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম কমছে, তাতে তো বিপিসির ভর্তুকি কাটিয়ে লাভও থাকবে। কিন্তু অর্থনীতির এ কঠিন সময়ের বিপিসির তো লাভের চিন্তা করা উচিত নয়।’ তিনি বলেন, দাম বাড়ার প্রভাবে সব ধরনের পরিবহনের খরচ বাড়বে। এতে মানুষের যাতায়াতের খরচসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ব্যবসা-উদ্যোক্তা-সরবরাহ সব পর্যায়ে খরচ বেড়ে যাবে। খরচ বাড়লে উৎপাদন কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ কমে যাবে, জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাবে। এতে দরিদ্র আরও দরিদ্র হবে, আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরের লোকজন দরিদ্র সীমার নিচে নেমে আসবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারকে তেলের দাম সমন্বয় করতেই হতো। তবে দাম সমন্বয়ের এটা সঠিক সময় ছিল না। দামও বেড়েছে অনেক বেশি। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেল। তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সরকারের উচিত ছিল জ্বালানির দামটা সহনীয় রাখা। তা না করে, যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে তা অসহনীয় ও সাংঘাতিক রকমের বেশি।

আইএমএফের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট–পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি খুবই সাহসী ও কঠিন সিদ্ধান্ত। এই দাম বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আগামী ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে।

মূল্যস্ফীতি বাড়বে

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ–ডিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রাহমান বলেন, একলাফে জ্বালানির দাম এত বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তিনি বলেন, এর ফলে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এটা হতে পারে না। দরকার হলে প্রতি মাসে দাম পুনর্নির্ধারণ করা যেত।

নিট পোশাকের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ফাইবার গ্রুপের পরিচালক ড. কামরুজ্জামান কায়সার বলেন, বিদ্যুতের রেশনিংয়ে এমনিতে উৎপাদন অন্তত ২০ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে নতুন করে এত বেশি হারে জ্বালানির দাম বাড়ানো রপ্তানি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। আমরা বুঝতে পারছি না যে, সামনে কী হবে। ক্রেতারা ইতিমধ্যে তাদের অর্ডারও কমিয়ে দিয়েছে। মন্দার কারণে দামও বেশি দিতে চাচ্ছে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত