নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
আওয়ামী লীগের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই লেখা লিখতে লিখতে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট, কবি, তার্কিক ইদরিস আলমের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন, রসুল (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের আগের ও পরের মুসলমানের মধ্যে অনেক তফাত। মক্কা বিজয়ের আগে যাঁরা রসুল (সা.)-এর কথায় ইমান এনে যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন, তাঁরা সাচ্চা মুসলমান। তখন পরিস্থিতি এত প্রতিকূল ছিল যে কাফেরদের অত্যাচারে রসুলকে হিজরত করে মদিনায় চলে যেতে হয়েছিল। অনেক যুদ্ধে কাফেরদের পরাজিত করে রসুল যখন চূড়ান্ত আঘাত হেনে বিজয়ীর বেশে বীরদর্পে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন ইসলামের জয়জয়কার। তখন অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে এগিয়ে এলেন। তাঁদের ইসলাম ধর্ম কবুল করার মধ্যে যেটা ফাঁকি সেটা হচ্ছে, তাঁরা ইসলামের বিজয়কালের মুসলমান। অনুকূল পরিবেশে মুসলমান শিবির যোগ দিয়েছিল। যাঁরা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর, স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে এবং ৯৬ ও ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের পর, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভরা জোয়ারের সময় দলে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমানদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশের দশককে উনপঞ্চাশে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগের শৈশব-কৈশোরকাল বলা যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিযাত্রায় আস্থা জ্ঞাপন করে দলের সদস্য হয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমানের উদাহরণ প্রযোজ্য হতে পারে। আটান্ন থেকে একষট্টি পর্যন্ত আইয়ুবের সামরিক শাসনকাল। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সাইনবোর্ড নামিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তার ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেই দুর্দিনে যাঁরা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, তাঁরাই প্রকৃত আওয়ামী লিগার। আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত অনুসারী। ছেষট্টি সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর দলটির ওপর চরম বিপদ নেমে এসেছিল। সেই সময় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ওপর ইমান এনে বা বিশ্বাস স্থাপন করে আওয়ামী লীগ করেছেন এবং ছয় দফাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠে-ময়দানে সভা, রাজপথে মিছিল করে, স্লোগানে গলা ফাটিয়ে প্রচার চালিয়েছিলেন, তাঁরাই আওয়ামী লীগের সত্যিকার নেতা এবং কর্মী; অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমানের সঙ্গে তুলনীয়। সেই সোনার মানুষদের কিছু নাম এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঢাকায় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান; মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, আহমেদ ফজলুর রহমান ও ড. জনসনখ্যাত শামসুর রহমান খান, নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারের শামসুজ্জোহা, মোস্তফা সরোয়ার ছাড়াও খসরু, পুরান ঢাকার নিজাম, ফজলুর রহমান ফান্টোমাস, হাফেজ মুসা, জিজি অর্থাৎ গাজী গোলাম মোস্তফা, আলী হোসেন, গাজীপুরের শামসুল হক (যিনি পরে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন), অবিভক্ত কমলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন (মেহের আফরোজ চুমকির পিতা), বিশিষ্ট সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কেরানীগঞ্জের হামিদ সাহেব (নসরুল হামিদ বিপুর পিতা), পোস্টার নুরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন (চলচ্চিত্র প্রযোজক), আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ফজলুর রহমান, বলিয়াদীর জমিদার পরিবারের আরহাম সিদ্দিকী, কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী আনিস, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের ভাই সুলতান, হাজিগঞ্জের বাদশা। বাহাউদ্দিন চৌধুরী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি একজন পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তিনি একসময় ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই তো আওয়ামী লীগ। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া, বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র গানের রচয়িতা, কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কে জি মুস্তাফা, এবিএম মূসা, এম আর আখতার মুকুল ছিলেন আওয়ামী লীগের শক্তি ও সাহসের উৎস।
ছয় দফার জন্য ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া এবং বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে কপের বৈঠকে ছয় দফা দেওয়ার পর সেই সংবাদ প্রথম ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। আর ছয় দফার পক্ষে ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মঈনুল আলমকে দিয়ে চট্টগ্রামের পাঁচজন রাজনৈতিক নেতার একটি বিবৃতি আনিয়ে সেটি ইত্তেফাকে প্রকাশ করেছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন।
আলী হোসেন আওয়ামী লীগের একেবারে প্রথম দিকের কর্মী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে রিক্রুট করেছিলেন। ধানমন্ডির শঙ্করের দিকে কোথাও থাকতেন তিনি। পরে ইস্কাটনে চলে আসেন। প্রায় আশি-উত্তীর্ণ বয়সে তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুর বছর দু-তিন আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঢাকায় প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের অবস্থা কেমন ছিল। তিনি তখন এ কথাগুলো বলেছিলেন—‘ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের কর্মী আমরা, মানে আমি, গাজী গোলাম মোস্তফা, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ভাই সুলতান, নিজাম, খসরু, নোয়াখালীর শফি (চট্টগ্রামের আশরাফ খানের মামাশ্বশুর), নাসের উল্লাহ, আনোয়ার চৌধুরী। মহল্লা সরদার কমিটির সভাপতি হাফিজ মুসা ছিলেন ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। হাফিজ মুসাকে সবাই নানা বলে সম্বোধন করত। আওয়ামী লীগ তখনো ছোট দল। হাতে গোনা নেতা-কর্মী, সেই হাতে গোনা মানুষের মধ্যে আরও ছিলেন শামসুল হক, ময়েজউদ্দিন, আরহাম সিদ্দিকী প্রমুখ। চট্টগ্রাম থেকে মানিকদা কীভাবে যেন তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকা আসতেন। পরীবাগে নবাব আসকারীর বাড়ির পাশে একটি হোটেলে থাকতেন। কখনো বা হোটেলে বসতেন, আড্ডা জমাতেন আমাদের নিয়ে। তাঁর আরেকটা প্রিয় অভ্যাস ছিল, আমাদের নিয়ে রমনা পার্কে বসা। ঢাকা তখন এত বড় শহর হয়নি, মহানগর তো নয়ই। সেই ছোট শহরের কোলে মনোরম বিকেলে মানিকদার পিছু নিয়ে আমরা কজন আওয়ামী লীগকর্মী প্রকৃতির নির্জনতায় চুপটি করে এসে পাটি-কাঁথা বিছিয়ে বসতাম রমনা লেকের পাড়ে। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম পাটে, সবুজ নিসর্গের ছায়া পড়েছে লেকে। সেই মন উদাস করা প্রকৃতির রাজ্যে আমরা কাঁচা হলুদের মতো গাত্রবর্ণের এক চট্টল সন্তানের তাম্বুল রসে রাঙা মুখনিঃসৃত গল্পে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে কান পেতে আছি। গল্পের ফাঁকে এসে পড়ত রাজনীতি। এমনি করে প্রথম যুগে অনেক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালের মধ্যে নানা কৌশলে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে হয়েছে। সিনেমার রিহার্সালের নামেও আমরা রাজনৈতিক বৈঠক করে ফেলতাম। রমনা পার্কের সেই বৈকালিক আড্ডায় ময়েজউদ্দিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, বিধান সেন, খসরু, নিজাম ও আমি ছিলাম নিয়মিত আড্ডারু। কাজী আনিসুজ্জামান আসতেন কখনো-সখনো।’
যখন খুব কম লোকই আওয়ামী লীগ করতেন, তখন উপরোল্লিখিত নেতারা আওয়ামী লীগের ঝান্ডা হাতে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ, নির্যাতন এবং অসচেতন মানুষের কটূক্তি, তিরস্কার হাসিমুখে মাথা পেতে নিয়ে নির্ভীক চিত্তে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে তাঁদের সপরিবারে সম্মান জানানো বর্তমান দলীয় নেতাদের দায়িত্ব বলে মনে করি। তাঁদের ক্রেস্ট, সম্মাননা, মাল্যভূষিত করে ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজপথে শোভাযাত্রা করা দরকার। এমনকি নগদ অর্থও দেওয়া যেতে পারে।
পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগ সীমাহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে কিছু গ্রেপ্তার হন, অন্যরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এই সময় অন্ধকারের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী গর্ত থেকে বের হয়ে এসে আস্ফালন শুরু করে। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ বুঝে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলায়। এদের দেখেই ইদরিস আলম বলেছিলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমান’।
আরও পড়ৃন:
আওয়ামী লীগের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই লেখা লিখতে লিখতে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট, কবি, তার্কিক ইদরিস আলমের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন, রসুল (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের আগের ও পরের মুসলমানের মধ্যে অনেক তফাত। মক্কা বিজয়ের আগে যাঁরা রসুল (সা.)-এর কথায় ইমান এনে যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন, তাঁরা সাচ্চা মুসলমান। তখন পরিস্থিতি এত প্রতিকূল ছিল যে কাফেরদের অত্যাচারে রসুলকে হিজরত করে মদিনায় চলে যেতে হয়েছিল। অনেক যুদ্ধে কাফেরদের পরাজিত করে রসুল যখন চূড়ান্ত আঘাত হেনে বিজয়ীর বেশে বীরদর্পে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন ইসলামের জয়জয়কার। তখন অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে এগিয়ে এলেন। তাঁদের ইসলাম ধর্ম কবুল করার মধ্যে যেটা ফাঁকি সেটা হচ্ছে, তাঁরা ইসলামের বিজয়কালের মুসলমান। অনুকূল পরিবেশে মুসলমান শিবির যোগ দিয়েছিল। যাঁরা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর, স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে এবং ৯৬ ও ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের পর, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভরা জোয়ারের সময় দলে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমানদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশের দশককে উনপঞ্চাশে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগের শৈশব-কৈশোরকাল বলা যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিযাত্রায় আস্থা জ্ঞাপন করে দলের সদস্য হয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমানের উদাহরণ প্রযোজ্য হতে পারে। আটান্ন থেকে একষট্টি পর্যন্ত আইয়ুবের সামরিক শাসনকাল। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সাইনবোর্ড নামিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তার ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেই দুর্দিনে যাঁরা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, তাঁরাই প্রকৃত আওয়ামী লিগার। আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত অনুসারী। ছেষট্টি সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর দলটির ওপর চরম বিপদ নেমে এসেছিল। সেই সময় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ওপর ইমান এনে বা বিশ্বাস স্থাপন করে আওয়ামী লীগ করেছেন এবং ছয় দফাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠে-ময়দানে সভা, রাজপথে মিছিল করে, স্লোগানে গলা ফাটিয়ে প্রচার চালিয়েছিলেন, তাঁরাই আওয়ামী লীগের সত্যিকার নেতা এবং কর্মী; অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমানের সঙ্গে তুলনীয়। সেই সোনার মানুষদের কিছু নাম এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঢাকায় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান; মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, সিএসপি রুহুল কুদ্দুস, আহমেদ ফজলুর রহমান ও ড. জনসনখ্যাত শামসুর রহমান খান, নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারের শামসুজ্জোহা, মোস্তফা সরোয়ার ছাড়াও খসরু, পুরান ঢাকার নিজাম, ফজলুর রহমান ফান্টোমাস, হাফেজ মুসা, জিজি অর্থাৎ গাজী গোলাম মোস্তফা, আলী হোসেন, গাজীপুরের শামসুল হক (যিনি পরে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন), অবিভক্ত কমলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন (মেহের আফরোজ চুমকির পিতা), বিশিষ্ট সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কেরানীগঞ্জের হামিদ সাহেব (নসরুল হামিদ বিপুর পিতা), পোস্টার নুরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন (চলচ্চিত্র প্রযোজক), আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ফজলুর রহমান, বলিয়াদীর জমিদার পরিবারের আরহাম সিদ্দিকী, কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী আনিস, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের ভাই সুলতান, হাজিগঞ্জের বাদশা। বাহাউদ্দিন চৌধুরী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি একজন পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তিনি একসময় ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই তো আওয়ামী লীগ। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া, বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র গানের রচয়িতা, কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কে জি মুস্তাফা, এবিএম মূসা, এম আর আখতার মুকুল ছিলেন আওয়ামী লীগের শক্তি ও সাহসের উৎস।
ছয় দফার জন্য ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া এবং বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে কপের বৈঠকে ছয় দফা দেওয়ার পর সেই সংবাদ প্রথম ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। আর ছয় দফার পক্ষে ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মঈনুল আলমকে দিয়ে চট্টগ্রামের পাঁচজন রাজনৈতিক নেতার একটি বিবৃতি আনিয়ে সেটি ইত্তেফাকে প্রকাশ করেছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন।
আলী হোসেন আওয়ামী লীগের একেবারে প্রথম দিকের কর্মী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে রিক্রুট করেছিলেন। ধানমন্ডির শঙ্করের দিকে কোথাও থাকতেন তিনি। পরে ইস্কাটনে চলে আসেন। প্রায় আশি-উত্তীর্ণ বয়সে তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুর বছর দু-তিন আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঢাকায় প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের অবস্থা কেমন ছিল। তিনি তখন এ কথাগুলো বলেছিলেন—‘ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের কর্মী আমরা, মানে আমি, গাজী গোলাম মোস্তফা, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ভাই সুলতান, নিজাম, খসরু, নোয়াখালীর শফি (চট্টগ্রামের আশরাফ খানের মামাশ্বশুর), নাসের উল্লাহ, আনোয়ার চৌধুরী। মহল্লা সরদার কমিটির সভাপতি হাফিজ মুসা ছিলেন ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। হাফিজ মুসাকে সবাই নানা বলে সম্বোধন করত। আওয়ামী লীগ তখনো ছোট দল। হাতে গোনা নেতা-কর্মী, সেই হাতে গোনা মানুষের মধ্যে আরও ছিলেন শামসুল হক, ময়েজউদ্দিন, আরহাম সিদ্দিকী প্রমুখ। চট্টগ্রাম থেকে মানিকদা কীভাবে যেন তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকা আসতেন। পরীবাগে নবাব আসকারীর বাড়ির পাশে একটি হোটেলে থাকতেন। কখনো বা হোটেলে বসতেন, আড্ডা জমাতেন আমাদের নিয়ে। তাঁর আরেকটা প্রিয় অভ্যাস ছিল, আমাদের নিয়ে রমনা পার্কে বসা। ঢাকা তখন এত বড় শহর হয়নি, মহানগর তো নয়ই। সেই ছোট শহরের কোলে মনোরম বিকেলে মানিকদার পিছু নিয়ে আমরা কজন আওয়ামী লীগকর্মী প্রকৃতির নির্জনতায় চুপটি করে এসে পাটি-কাঁথা বিছিয়ে বসতাম রমনা লেকের পাড়ে। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম পাটে, সবুজ নিসর্গের ছায়া পড়েছে লেকে। সেই মন উদাস করা প্রকৃতির রাজ্যে আমরা কাঁচা হলুদের মতো গাত্রবর্ণের এক চট্টল সন্তানের তাম্বুল রসে রাঙা মুখনিঃসৃত গল্পে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে কান পেতে আছি। গল্পের ফাঁকে এসে পড়ত রাজনীতি। এমনি করে প্রথম যুগে অনেক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালের মধ্যে নানা কৌশলে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে হয়েছে। সিনেমার রিহার্সালের নামেও আমরা রাজনৈতিক বৈঠক করে ফেলতাম। রমনা পার্কের সেই বৈকালিক আড্ডায় ময়েজউদ্দিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, বিধান সেন, খসরু, নিজাম ও আমি ছিলাম নিয়মিত আড্ডারু। কাজী আনিসুজ্জামান আসতেন কখনো-সখনো।’
যখন খুব কম লোকই আওয়ামী লীগ করতেন, তখন উপরোল্লিখিত নেতারা আওয়ামী লীগের ঝান্ডা হাতে পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ, নির্যাতন এবং অসচেতন মানুষের কটূক্তি, তিরস্কার হাসিমুখে মাথা পেতে নিয়ে নির্ভীক চিত্তে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে তাঁদের সপরিবারে সম্মান জানানো বর্তমান দলীয় নেতাদের দায়িত্ব বলে মনে করি। তাঁদের ক্রেস্ট, সম্মাননা, মাল্যভূষিত করে ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজপথে শোভাযাত্রা করা দরকার। এমনকি নগদ অর্থও দেওয়া যেতে পারে।
পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগ সীমাহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে কিছু গ্রেপ্তার হন, অন্যরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এই সময় অন্ধকারের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী গর্ত থেকে বের হয়ে এসে আস্ফালন শুরু করে। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ বুঝে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মেলায়। এদের দেখেই ইদরিস আলম বলেছিলেন, ‘মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমান’।
আরও পড়ৃন:
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪