Ajker Patrika

মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় খুন—কীভাবে এক নববধূ হয়ে উঠলেন হত্যাকারী

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৯ জুন ২০২৫, ২১: ৪৫
সোনম রঘুবংশী ও রাজা রঘুবংশী। ছবি: এনডিটিভি
সোনম রঘুবংশী ও রাজা রঘুবংশী। ছবি: এনডিটিভি

এটি কোনো থ্রিলার ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য নয়, বরং বাস্তবের নির্মম এক ঘটনা। দুটি নামী পরিবার, একটি পরিকল্পিত বিয়ে এবং এক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড। ঘটনাস্থল ভারতের মেঘালয়ের রহস্যে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চল।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার শুরুটা হয়েছিল একটি পুস্তিকায় দুজনের নাম ছাপা হওয়ার মাধ্যমে। আর শেষ হয়েছে গভীর জঙ্গলে একটি লাশ পড়ে থাকার মধ্যে দিয়ে।

ঐতিহ্যবাহী পরিবহন ব্যবসার কনিষ্ঠ উত্তরাধিকারী রাজা রঘুবংশী

রাজা রঘুবংশী ছিলেন মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরের সহকার নগরে বাস করা একটি নামী-দামি যৌথ পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র। ‘রঘুবংশী ট্রান্সপোর্ট’ এই পরিবারের অন্যতম ব্যবসা। ২০০৭ সাল থেকেই তারা স্কুল ও কোচিং সেন্টারে বাস ভাড়া দিত। খুব বেশি দিন হয়নি, রাজা এই ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরিবারের সবারই এক কথা—রাজা ছিলেন পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল এবং বিয়ের জন্য উপযুক্ত।

এ অবস্থায় গত ১১ মে সোনম রঘুবংশীকে বিয়ে করেন রাজা। ১২ দিন পর গত ২৩ মে তাঁরা দুজনই নিখোঁজ হন। নিখোঁজের ১০ দিন পর রাজার নিথর দেহ উদ্ধার হয় মেঘালয়ের একটি গভীর জঙ্গল থেকে। তাঁর মাথায় ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাত, সম্ভবত একটি দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর ফোন বন্ধ ছিল, শেষ মুহূর্তের কল রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। আর নববধূ সোনম? সে ছিল তখনো নিখোঁজ।

সোনম রঘুবংশী: উদ্যোক্তা না কৌশলী হত্যাকারী?

সোনম ছিলেন ইন্দোর শহরেরই কুশওয়াহ নগরের বাসিন্দা। প্লাইউড ফ্যাক্টরি মালিক দেবী সিং রঘুবংশীর কন্যা তিনি। পারিবারিক এই ব্যবসার হিসাব, তদারকি থেকে শুরু করে প্রায় সব বিভাগ চালাতেন সোনম।

বছর কয়েক আগে সেই ফ্যাক্টরির বিলিং বিভাগে কাজ করত রাজ কুশওয়াহ নামে এক যুবক। সোনমদের পাড়ারই বাসিন্দা ছিলেন তিনি। এখন পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, রাজা হত্যাকাণ্ডে সেই রাজই মূল সন্দেহভাজন, সহ-চক্রান্তকারী ও সহ-হত্যাকারী।

প্রশ্ন উঠেছে, সোনমের ব্যবসায় রাজ কুশওয়াহ কি সত্যিই শুধু একজন সাবেক কর্মচারী হিসেবেই ছিলেন, নাকি আরও গভীর কিছু?

পুস্তিকায় পরিচয়, সম্পর্কের আড়ালে অন্ধকার

ভারতীয় এনডিটিভির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর রামনবমীর এক ঐতিহ্যবাহী রীতির অংশ হিসেবে ‘সমাজ পরিচয় পুস্তিকা’য় সোনম ও রাজার নাম প্রকাশিত হয়। সেই পুস্তিকা থেকেই তাঁদের পরিচয় শুরু।

বিয়ের সিদ্ধান্ত হয় দুই পরিবারের সম্মতিতে। রাজার মা উমা রঘুবংশীর ভাষায়, ‘সবকিছু পারিবারিকভাবে হয়েছিল। কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না, কোনো গোপন বিষয় ছিল না।’

কিন্তু হয়তো অজান্তেই তখন থেকেই জন্ম নিচ্ছিল এক অন্ধকার পরিকল্পনা। গত ২৩ মে মেঘালয়ের পূর্ব খাসি পাহাড়ের চেরাপুঞ্জিতে মধুচন্দ্রিমায় যান সদ্য বিবাহিত রাজা রঘুবংশী ও সোনম। এর আগের দিন তাঁরা নংগ্রিয়ায় পৌঁছে ‘বালাজি হোমস্টে’ নামে একটি হোটেলে ওঠেন। পরদিন সকালে সেখান থেকে চেক আউট করেন ওই নবদম্পতি। এরপর থেকে তাঁদের আর খোঁজ মেলেনি। যে স্কুটার তাঁরা ভাড়া করেছিলেন, তা পরদিন সোহারিম এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়।

নিখোঁজের ১০ দিন পর গত ২ জুন রিয়াত আর্লিয়াং অঞ্চলে ‘ওয়েইসাওডং পার্কিং লট’-এর নিচে একটি গভীর গিরিখাদে মেলে রাজার মরদেহ। মরদেহের পাশ থেকে একটি ধারালো চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, এটি দিয়েই হত্যা করা হয়েছে তাঁকে।

এক গাইড দাবি করেন, ২৩ মে সকাল ১০টা নাগাদ তিনি দম্পতিকে তিন পুরুষের সঙ্গে মাওলাখিয়ায় ৩ হাজার ধাপের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখেছিলেন। গাইড বলেন, ‘২২ মে আমি নিজেই তাঁদের গাইড হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে অন্য একজন গাইড বেছে নেন।’

পুলিশ ইতিমধ্যে সোনম রঘুবংশী, রাজ কুশওয়াহ এবং আরও তিন ভাড়াটে খুনিকে গ্রেপ্তার করেছে। গত শনিবার রাতে উত্তর প্রদেশের গাজিপুরে একটি ধাবায় অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সোনমকে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে গাজিপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ওই নারী। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

মেঘালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (ডিজিপি) ইদাশিশা নংরাং জানান, রাতভর অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন খুনিদের মধ্যে একজনকে উত্তর প্রদেশ এবং বাকি দুজনকে ইন্দোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজাকে হত্যার জন্য সোনম তাঁদের ভাড়া করেছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, সব তথ্য একত্র করেই হত্যার মূল পরিকল্পনা, সময় ও সহযোগীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এ ঘটনায় মেঘালয়ের পর্যটন নিরাপত্তা ও গাইড লাইসেন্সিং পদ্ধতি নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ড ‘পুরোপুরি পূর্বপরিকল্পিত’ এবং ‘চমকে দেওয়ার মতো নির্মম’।

এদিকে রাজাকে খুনের ঘটনায় নতুন তথ্য দিলেন তাঁর মা উমা রঘুবংশী। তিনি জানান, রাজা হানিমুনে যাওয়ার সময় ১০ লাখ রুপিরও (১৪ লাখের বেশি টাকা) বেশি মূল্যের সোনার গয়না পরে ছিলেন—যার মধ্যে ছিল একটি হিরের আংটি, একটি চেইন এবং একটি ব্রেসলেট। এসব গয়না পরার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সোনম রঘুবংশী।

রাজার উমা রঘুবংশী বলেন, ‘সোনম সব টিকিট বুক করেছিল—যাতায়াত ও থাকার। তবে ফেরার কোনো টিকিট বুক করেনি। সে হয়তো শিলং পর্যন্ত ভ্রমণ বাড়িয়েছিল। কারণ আমার ছেলে সেই এলাকা চিনত না। সোনমের মা বলেছেন, তারা গত বছরও শিলং গিয়েছিলেন।’

উমা রঘুবংশী আরও জানান, ‘যখন আমি রাজাকে এত সোনা পরে যেতে দেখেছিলাম, জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল, সোনম চায় সে এগুলো পরে যাক। এখন যদি সোনম এই খুনে জড়িত থাকে, তবে তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। পুলিশ সকালে আমাদের জানায়নি যে সোনমকে পাওয়া গেছে। আমি চাই, এই ঘটনায় সিবিআই তদন্ত হোক। যদি সে নির্দোষ হয়, তবে কেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে? সোনম তো ভালো ব্যবহার করত, আমাকে জড়িয়ে ধরত।’

উমা রঘুবংশীর প্রশ্ন, ‘যদি সে আমার ছেলেকে ভালোবাসত, তবে কীভাবে তাকে মরতে দিল? সে কীভাবে নিরাপদে রইল? যারা এর পেছনে আছে, সবাইকে কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিত।’

পুলিশের দাবি, সোনমের একটি পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। রাজু কুশওয়াহার নামের সেই প্রেমিকের সঙ্গে মিলে ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করে রাজাকে হত্যা করেন সোনম। তদন্তে জানা গেছে, সোনম প্রায়শই রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা তিন-চারজন সন্দেহভাজন খুনি এই ঘটনায় জড়িত।

রাজা তথা ইন্দোরের রঘুবংশী পরিবার এখনো শোকে স্তব্ধ। আর পুরো ভারতজুড়ে একটাই প্রশ্ন—এটি কি প্রেম ছিল, না মৃত্যু-পরিকল্পনার আড়ালে একটি ছদ্মবিবাহ? তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে কী বেরিয়ে আসে, তার অপেক্ষায় এখন সবাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পালানোর গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরলেন আবদুল হামিদ

মেঘালয়ে হানিমুনের সময় ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামীকে হত্যা, উত্তর প্রদেশে নববধূর আত্মসমর্পণ

কানাডার লেকে বোট উল্টে বাংলাদেশের পাইলট ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় খুন—কীভাবে এক নববধূ হয়ে উঠলেন হত্যাকারী

ভিকারুননিসার ছাত্রী মেয়েকে সাঁতার শেখাচ্ছিলেন বাবা, ডুবে প্রাণ গেল দুজনেরই

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত