Ajker Patrika

পাথর পাচারে খালে বাঁধ

বদরুল ইসলাম মাসুদ, বান্দরবান
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ৪৩
পাথর পাচারে খালে বাঁধ

বান্দরবান সদরের বিভিন্ন ঝিরি, খাল, ছড়া থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন মহলকে হাতে নিয়ে পাথর উত্তোলন ও পাচার অব্যাহত রেখেছেন প্রভাবশালীরা। এমনকি পাথর পাচারের জন্য পাহাড় কেটে ৪ কিলোমিটার রাস্তা তৈরিও করা হচ্ছে। এ জন্য খালের অন্তত ১৪ জায়গায় ছোট-বড় বাঁধ দেওয়া হয়েছে।

এসব কাজে এগিয়ে আছেন সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রহিম কোম্পানি। স্থানীয়ভাবে তাঁকে ‘পাথর রহিম’ নামেও ডাকে লোকজন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিএনপিসহ অন্য দলের কোনো কোনো নেতা।

এ বিষয়ে দলীয়ভাবে আলোচনার পাশাপাশি সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী ও বান্দরবানের সাংসদ বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর কাছে অভিযোগ করেছেন টংকাবতী ইউপি চেয়ারম্যান মাংইয়াং ম্রয় প্রদীপ ম্রো। মন্ত্রী বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের দেখার নির্দেশও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এখনো চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। এলাকা ঘুরে এর সত্যতাও পেয়েছেন জেলার সাংবাদিকেরা।

জেলা প্রশাসন বলছে, বান্দরবানে পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাথর তোলার কোনো সুযোগই নেই। সম্প্রতি থানচিতে পাথর উত্তোলনের সময় অভিযান চালিয়ে বিপুল পাথর জব্দ ও পাথর ভাঙার মেশিন ধ্বংস করেছে প্রশাসন ও পরিবেশ বিভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহিম টংকাবতী ও থানচি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ঝিরি-ঝরনা, খাল-ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। এই কাজে রুমা উপজেলার বিএনপি নেতা বিপ্লব মারমা ও মো. ইসলাম, যুবলীগ নেতা উচনু মেম্বার, জামায়াত নেতা ইমরান হোসেন, লামা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আনোয়ার, থানচি বিএনপি নেতা আবদুল কুদ্দুছ ও মো. জসিম উদ্দিন মিলে অবৈধ পাথর বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাঁদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতা রহিম কোম্পানির কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাথর উত্তোলন ও পাচারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত।

এদিকে রহিম কোম্পানির পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি, অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন নিয়ে অস্বস্তিতে আছে আওয়ামী লীগ। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পাইহ্লা অং মারমভ বলেন, ‘আমরাও রহিম কোম্পানির পাথর উত্তোলন ও গাছ কাটার বিষয়টি শুনেছি। তিনি যদি অপরাধ করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টংকাবতী এলাকার কয়েকজন ম্রো বাসিন্দা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা রহিম কোম্পানি অবৈধভাবে গাছ কাটা ও পাথর উত্তোলনের নিরাপদ রুট বানিয়েছেন। এলাকাটি বান্দরবান সদরের হলেও পাহাড়ি, দুর্গম হওয়ায় এবং পাশেই চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা থাকায় সহজেই তিনি পাথর ব্যবসা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলার সাহস পান না।’

সরেজমিন দেখা গেছে, টংকাবতী ইউনিয়নের বিভিন্ন ঝিরি-খাল থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে প্রথমে এক স্থানে মজুত করা হয়। পরে সেগুলো ট্রাকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ জন্য রমজুপাড়া থেকে বলিপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে খালের ওপর ছোট-বড় ১৪টি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। খালজুড়ে কোথাও পাথরের স্তূপ, কোথাও গাছের স্তূপ দেখা গেছে। নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে ওই এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

টংকাবতীর দনরুইপাড়া কার্বারি দনরুই ম্রো বলেন, ‘এ পাড়ায় ২৭টি ম্রো পরিবার বাস করে। এর মধ্যে আটটি পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছে। এসব ঘর নির্মাণের ইট নিয়ে আনার কথা বলে আবদুর রহিম কোম্পানি টংকাবতী-রমজুপাড়া-বলিপাড়া রাস্তাটি পাহাড় কেটে করেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে ওই রাস্তা দিয়ে রহিম কোম্পানি গাছ ও পাথর নিয়ে যাচ্ছেন।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পাড়া কার্বারিরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘রহিম কোম্পানি টংকাবতীর রমজুপাড়া এলাকায় খাল ও ঝিরি-ছড়া থেকে পাথর উত্তোলন করছেন। টংকাবতীর দক্ষিণ হাঙর খালে এসে পড়া ৮টি ছড়ার পাথর তুলে নিচ্ছেন তিনি। এসব বন্ধে গত ২৬ জানুয়ারি ওই এলাকার পাড়া কার্বারিরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন।’

পাথর উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আবদুর রহিম কোম্পানি বলেন, তিনি কোনো পাথর উত্তোলন করছেন না।

বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হক মাহাবুব মোর্শেদ বলেন, ‘পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি ও ঝিরি থেকে পাথর তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের দেখার দায়িত্ব।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আবদুস সালাম বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘বান্দরবানে পাথর আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ পাথর উত্তোলন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত