Ajker Patrika

স্বাদের গল্প কি বদলে যাচ্ছে

মইনুল হাসান, ফ্রান্স
স্বাদের গল্প কি বদলে যাচ্ছে

গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো পরীক্ষাগারে উৎপাদিত মাংসের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।ক্যালিফোর্নিয়ার একটি স্টার্টআপ আপসাইড ফুডস গবেষণাগারে উৎপাদিত মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল। তাদের আবেদন গৃহীত হয়েছে। মানুষের খাদ্য হিসেবে গবেষণাগারে উৎপাদিত মাংস স্বীকৃতি পেয়েছে। পশু-পাখি ছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত এমন মাংস বাজারজাত করায় এখন আর কোনো বাধা নেই। নির্দ্বিধায় বলা চলে, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ছাড়িয়ে মানুষের আবহমান খাদ্য সংস্কৃতিতে নতুন যুগের সূচনা হলো।

আপসাইড ফুডস জানিয়েছে, এই মাংস মোটেই উদ্ভিজ্জ নয়। তাঁরা নিশ্চয়তা দিলেন যে এমন মাংসের সঙ্গে স্বাদে, গন্ধে ও গঠনে প্রচলিত মাংসের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে, এগুলো প্রাণী ছাড়া উৎপাদিত। শুধু গরু বা মুরগির মতো প্রাণীর একটুখানি কোষের নমুনা থেকে ল্যাবরেটরিতে পরিচ্ছন্ন এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উৎপাদিত এমন মাংস পুষ্টিমানে উন্নত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। তা ছাড়া, মানুষের রসনা মেটাতে এখন থেকে আর কোনো প্রাণীর প্রাণ সংহার করতে হবে না।

ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন হলেও সিঙ্গাপুরে তা মোটেই নতুন নয়। সিঙ্গাপুরের খাদ্যনিরাপত্তা বিভাগ ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর গবেষণাগারে তৈরি মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই ইউরোপের খাবার টেবিলে জায়গা করে নেবে ল্যাবে উৎপাদিত মাংস এবং মাংসজাত রকমারি খাবার।

অনেকটা কাকতালীয় হলেও, এ খবরটি যখন এসেছে, ঠিক তখনই গত সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর পৃথিবীতে প্রথমবারে মতো মানুষের সংখ্যাও আট শ কোটি ছাড়িয়েছে। ২১০০ সালের আগে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গবেষণাগারে উৎপাদিত মুরগির মাংস ২০২০ সালে প্রথম সিঙ্গাপুরে বাজারজাত করে ইট জাস্টবর্তমানে প্রতি ১০ জনে ১ জন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। ভবিষ্যতে খাদ্য সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে বলে সতর্ক সংকেত দিয়েছেন গবেষকেরা। এসব বিবেচনায় ভবিষ্যতে খাদ্য সমস্যার সমাধানে জৈবপ্রযুক্তিবিদেরা আমিষের প্রচলিত উৎস পশু-পাখি ও মাছকে পাশ কাটিয়ে খাদ্যের নতুন উৎসের সন্ধান দিচ্ছেন। কারণ যেসব পশু-পাখি বা মাছ আমরা লালন-পালন করি তা বেশ সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এ জন্য বাড়তি জায়গা এবং পানযোগ্য পানির বিপুল অপচয় হয়। তার ওপর ব্যাপক রাসায়নিক সার, কীট-পতঙ্গ, আবর্জনা নাশক ইত্যাদি ব্যবহার মোটেই পরিবেশবান্ধব নয়। চাষযোগ্য জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে দ্রুত। মানুষ এবং পালিত পশু-পাখি, মাছের জন্য খাদ্য জোগাতে উজাড় হচ্ছে বনভূমি। এর সঙ্গে আছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন।

সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রথমবারের মতো গত বছরের ৪ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সংস্থা গুবরেপোকার লার্ভা বা শুককীট মানুষের খাদ্য হিসেবে নিরাপদ বলে ছাড়পত্র দিয়েছে। শুকনো গুবরেপোকার লার্ভার পুষ্টিকর আটা দিয়ে রুটি, বিস্কুট, বাহারি কেক স্বাদে-গন্ধে মানুষের মন কাড়তে শুরু করেছে।

খাদ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন এবং প্রচলিত মাংসের বিকল্প এমন মাংস মানুষের জন্য নিরাপদ ‘ক্লিন মিট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ‘ক্লিন মিট’ কথাটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে এ জন্যই যে এই মাংস দূষণমুক্ত। এতে থাকছে না ক্ষতিকর অণুজীব, ভাইরাস, ছত্রাক, পরজীবী, চর্বি, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক, ভারী ধাতু ও মাইক্রোপ্লাস্টিক।

আপসাইড ফুডসের মুরগির কোষ থেকে গবেষণাগারে উৎপাদিত মাংস থেকে বানানো খাবারএদিকে জৈবপ্রযুক্তিবিদেরা জানিয়েছেন যে অণুজীব থেকে দুধ, ডিম, মজার চকলেট উৎপাদনের জৈবপ্রযুক্তি তাঁদের হাতের মুঠোয় আছে। পুষ্টিগুণের সঙ্গে রং, ঘ্রাণ, স্বাদ আর গঠন বিবেচনায় অণুজীব উৎপাদিত এসব খাবার মোটেই কম যায় না; বরং বেশ কিছু পুষ্টিগুণ যোগ করে স্বাস্থ্যের জন্য আরও উত্তম করা যাবে বলে জানিয়েছেন জৈবপ্রযুক্তিবিদেরা।

এটা এখন নিশ্চিত যে আজকালের মধ্যেই বাজারে এসে যাচ্ছে প্রাণী ছাড়াই মাছ-মাংস আর বহুল জনপ্রিয় খাদ্য ডিম। পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে অনেকটাই আটঘাট বেঁধে নেমেছে। আর তাই কোফতা, কারি, রেজালা, কাবাব, চপ-কাটলেট, বার্গার ইত্যাদি মজাদার খাবারের কথা মনে করে এখনই অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, স্বাদের গল্প কি বদলে যাচ্ছে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত