বিপদে আছে মেছো বিড়াল

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৪: ২৪
Thumbnail image

কয়েক বছর আগের কথা। কাপ্তাই গিয়েছি বেড়াতে। আস্তানা গেড়েছি বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিসের কোয়ার্টারে। ওখানে একটা সার্চ লাইট আছে। রাতে পাহারাদার বনকর্মী এর আলো ফেলে কর্ণফুলী নদীর জলে, চোরাই কাঠ বোঝাই নৌকার খোঁজে। আমিও ঠায় বসে থাকি, যদি এর আলোয় পানি খেতে আসা কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে। শেষমেশ ধৈর্যের ফল মিলল। সার্চ লাইটের আলোয় তৃতীয় রাতে আবিষ্কার করলাম নদীর ওপারে সীতা পাহাড়ের দিকটায় জ্বলজ্বলে এক জোড়া চোখ। আলোটা স্থির করতেই অন্ধকারের রাজ্যে আবছাভাবে দেখা গেল শরীরটা। পরমুহূর্তেই ওটা হাওয়া। ততক্ষণে পরিচয় জানা হয়ে গিয়েছে, মেছো বিড়াল। হয় পানি খেতে নতুবা মাছ শিকারে বেরিয়েছিল। 

বাংলাদেশে যে আট জাতের বুনো বিড়ালের বাস, তার একটি এই মেছো বিড়াল। ইংরেজি নাম ফিশিং ক্যাট। অনেকে একে মেছো বাঘ বা বাঘুইলা নামেও চেনে। 

মেছো বাঘ নামের কারণে এই জন্তুটা অনেক সময়ই বিপদে পড়ে যায়। নামের সঙ্গে বাঘ থাকার অপরাধে এদের পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ। আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় চিতা বাঘ দেখা গিয়েছে কিংবা ধরা পড়েছে বলে শোনা যায়, তার বেশির ভাগই আসলে মেছো বিড়াল। 

এবার জন্তুটা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ধূসর শরীরে লম্বালম্বি কয়েক সারি হলুদ ডোরা এদের চেহারাটা ভারি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। লেজসহ লম্বায় সাড়ে তিন ফুট। শরীরটা বেশ ভারী, তবে পা খাটো। 

শুনে অবাক হবেন, এক সময় ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ও ডেমরা এলাকাতে এদের দেখা যেত। অবশ্য সেটা, ১৯৮০ সালের আশপাশের সময়ের ঘটনা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগের বনগুলোতে এরা বেশ আছে। সুন্দরবনও এদের বড় ঘাঁটি। তেমনি আছে অনেক গ্রামীণ বনেই। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হাওর এলাকায়। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের আশপাশে মাঝেমধ্যেই মানুষের হাতে মেছো বিড়াল ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায়। 

প্রথমবার যখন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের কালঙ্গোর বনে গিয়েছিলাম যখন, তখন বন বাংলোর পেছনের পাহাড়ে বিশাল একটি মেছো বাঘের আড্ডাখানা ছিল। রাতে ওটা যখন শিকারে বের হয়, তখন এক পলক দেখার জন্য জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। তবে দেখা পাইনি। সিলেট বিভাগের কালেঙ্গা, সাতছড়ি, লাউয়াছড়া, লাঠিটিলার মতো বনগুলোতে এখনো বেশ আছে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় চমৎকার স্বাস্থ্যের তিনটা মেছো বিড়াল দেখেছিলাম। 

এবার একটু অন্য ধরনের একটি ঘটনা। অন্তত বছর কুড়ি আগে ঘটেছিল এটা। গাজীপুরের কালিগঞ্জের এক শালবনের আশপাশের মানুষের মধ্যে হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাতের বেলা বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা গ্রামের আশপাশে অদ্ভুত একটা সাদা জিনিস বা প্রাণী নজরে পড়ছে তাদের। এর নাম দিয়ে দিল তারা ‘সাদা ভূত’। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, মানুষজন জঙ্গলের আশপাশ ঘেঁষা বাদ দিয়ে দিল। এদিকে ওই এলাকার বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন বন্যপ্রাণীপ্রেমী সরওয়ার পাঠান। এক রাতে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ তীব্র হুটোপুটির আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে দেখলেন, দুটো মেছো বাঘ তুমুল লড়াই করছে। একটার চেহারা সাধারণ; কিন্তু আরেকটার গায়ের রং সাদা। তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এটা অ্যালবিনো। একে নিয়েই গ্রামের লোকের এত ভয়। 

অ্যালবিনিজম হলো একটি জন্মগত ব্যাপার, এর প্রভাবে চুল, চোখ ও ত্বক স্বাভাবিক রঙের বদলে হয়ে যায় সাদা। আমাদের ত্বকে মেলানিন নামে যে রঞ্জক থাকে, অ্যালবিনো প্রাণীর মধ্যে সেটি থাকে না, যার কারণে তারা ধবধবে সাদা হয়। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যালবিনো মেছো বিড়াল ছিল নিঃসন্দেহে শ্রীমঙ্গলের সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানার সেই সাদা মেছো বাঘ। বেশ কয়েকবারই ওটাকে দেখেছিলাম। অবশ্য এখন ওটাকে আর দেখার সুযোগ নেই। বছর কয়েক আগে বয়স হয়েই মারা গেছে ওই মেছো বাঘটা। 

মেছো বিড়ালদের পছন্দের খাবার মেনুতে আছে মাছ থেকে শুরু করে খরগোশ, বন মোরগসহ খুদে স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী। অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ সুযোগ পেলে গ্রামের মানুষের হাঁস-মুরগি, ছাগল শিকার করে খাওয়ার অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে। কোথাও এদের দেখা গেছে এমন খবর পেলেই হয়েছে। সারা গ্রামের মানুষ এক হয়ে আচ্ছাসে পিটিয়ে এদের দুনিয়ার মায়া কাটাতে বাধ্য করে। এভাবে গ্রামীণ বন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আশ্চর্য সুন্দর এই জন্তু। আবার রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির চাপায়ও মারা পড়ে অনেকগুলো। 

বাংলাদেশ ছাড়া এদের পাবেন ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেই। 

তবে শেষটা একটা ভালো খবর দিয়ে করতে চাই। পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটি দেখে খুশি হয়ে উঠেছে মনটা। গত মঙ্গলবারে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার দোড়গোড়ীয়া গ্রামে একটি মেছো বিড়াল আটকা পড়ে ফাঁদে। ওই অবস্থাতেই চারটা বাচ্চা হয় জন্তুটার। খবরটা জানানো হয় বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে। তারা গিয়ে দেখলেন খাঁচাবন্দী মেছো বিড়াল দেখতে গোটা গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে। তবে এসবে কোনো পরোয়া নেই মা মেছো বিড়ালের। বাচ্চাগুলোকে একমনে বুকের দুধ পান করাচ্ছে। শেষমেশ গ্রামের মানুষদের বুঝিয়ে মেছো বাঘটাকে বাচ্চাসহ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে একাকী যায় মা মেছো বিড়াল। তবে কিছুক্ষণ পর, সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ফিরে আসে মা, নিয়ে যায় বাচ্চাগুলোকে। এভাবেই গোটা দেশে ভালো থাকুক মেছো বিড়ালেরা। দেশের গ্রামীণ বনে, পাহাড়ি বনে, হাওর এলাকায়, সুন্দরবনে সব জায়গায় ছানা-পোনা নিয়ে আনন্দে দিন কাটুক তাদের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত