Ajker Patrika

আবু সাঈদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান

শাহারিয়ার সোহাগ
আবু সাঈদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান

২০১৮ সালে বাতিল হওয়া কোটা পদ্ধতি পূর্ণরূপে পুনর্বহাল হলে সারা দেশের মতো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ২০২৪ সালের ৫ জুন আন্দোলনে সক্রিয় হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রতিবাদ হয় ৩০ জুন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বাংলা বিভাগের শামসুর রহমান সুমন, ইংরেজি বিভাগের মো. শফিকুল ইসলাম, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ফয়সাল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গোলাম শাওন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কামরুল হাসান কাব্যসহ আরও কয়েকজন।

যৌক্তিক সংস্কারের দাবি

প্রথম দিন তাঁদের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।’ আমি তখন কামরুল হাসান কাব্যকে বলি, ‘কোটার ৫৬ শতাংশ যেমন অযৌক্তিক, তেমনি শূন্য শতাংশও অসাংবিধানিক। আমাদের উচিত কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কারের দাবি তোলা।’ এরপরে আন্দোলনের সুর পাল্টায়। আন্দোলন রূপ নেয় ‘পুনর্বহাল’ নয়, ‘সংস্কার’-এর দাবিতে। ১ জুলাইয়ের আন্দোলনে আবু সাঈদ ভাইসহ অনেকে যুক্ত হলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ওই দিন আমি গণমাধ্যমকে বলেছিলাম, ‘যখন আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষা, গবেষণা ও খেলাধুলায়, তখন আমাদের এই কোটা আন্দোলন একটি ভাত দে টাইপের অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।’

ছাত্রলীগের বাধা

৭ জুলাই সারা দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের মডার্ন মোড়ে আমরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছিলাম। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলন তুলে নিতে বলেন। কেউ কেউ তাঁর অন্যায় নির্দেশ মেনে নিতে চাইলেও আমি প্রকাশ্যে তার প্রতিবাদ করি। আমার সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও সাহস করে দাঁড়িয়ে যান। পোমেল বড়ুয়া স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

বহিষ্কার, হামলা

৭ জুলাইয়ের এই প্রতিরোধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় ভেঙে দেয়। ১০ জুলাই আন্দোলনের একটি অংশ আমাকে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করে। পরদিন

১১ জুলাই, পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ দলবদ্ধভাবে হামলা চালায়। আবু সাঈদ ভাই সামনে থেকে প্রতিরোধ করেন এবং লাঞ্ছনার শিকার হন। এরপর আবু সাঈদ ভাই আমাকে আবার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় গ্রুপে যুক্ত করেন এবং ‘সমন্বয় সারা দেশ’ গ্রুপেও যুক্ত করেন।

১২ জুলাই একটি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রকৃত আন্দোলনকারীদের দিয়ে সমন্বয় প্যানেল পুনর্গঠন করা হবে। ইংরেজি বিভাগের সাবিনা ইয়াসমিন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যয়ন বিভাগের সাবিনা আক্তারকে যুক্ত করে একটি নতুন প্যানেল গঠন করা হয়।

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

১৪ জুলাই শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্যের প্রতিবাদে সারা দেশের মতো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেদিন রাতেই ছাত্রীরা হলের তালা ভেঙে বিক্ষোভে নামেন। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ওই রাতে রূপ নেয় ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’-এ। এই হামলার পর অনেকে সরে দাঁড়ান, কিন্তু নেতৃত্বে উঠে আসেন আশিকুর রহমান আশিক ও আকিব ভাই। ১৫ জুলাই রাতে আমরা আবু সাঈদ ভাইয়ের ছাত্রাবাসে গিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলি। পরদিন ১৬ জুলাই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তবে তখন পরিস্থিতি ভীষণ কঠিন। সাউন্ড সিস্টেম কেউ ভাড়া দিচ্ছিল না—ভয়ে। তখন রংপুরের গণসংহতি আন্দোলনের নেতা তৌহিদুর রহমান সহায়তার হাত বাড়ান। তাঁর সহায়তায় হ্যান্ডমাইক ও আত্মরক্ষার জন্য ৫০টি এসএস পাইপের সঙ্গে জাতীয় পতাকা বেঁধে নেওয়া হয়।

প্রাথমিক ঘোষণা অনুযায়ী, আমাদের কর্মসূচি বেলা তিনটায় হওয়ার কথা থাকলেও সকাল সোয়া ১০টায় সেটি এগিয়ে আনা হয় বেলা ১১টায়। এর ফলে ছাত্রলীগ আগাম হামলা করতে পারেনি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর কলেজ, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ—সব জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হন।

বেলা আড়াইটা। ঘটে সেই নির্মম ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে বিশাল মিছিল এগিয়ে যায়। ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে গুলি করতে শুরু করে। তখন আবু সাঈদ ভাই সবার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তাঁর হাতে ছিল একটি লাঠি। আমি তখন মাইক হাতে তাঁর ঠিক পেছনে ছিলাম। বারবার সাঈদ ভাইকে সরে যেতে বলি। পেছন থেকে প্রাণপণ ডাকলেও তিনি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েই ছিলেন। ৫০ থেকে ৬০ ফুট দূর থেকে তাঁকে টার্গেট করে পুলিশ গুলি করে। একের পর এক গুলি বিঁধে তাঁর শরীরে। একপর্যায়ে তিনি শহীদ হন।

আবু সাঈদ ছিলেন এক নীরব প্রতিরোধ, যিনি নিজের প্রাণ দিয়ে প্রজন্মকে শিখিয়ে গেছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। তাঁর মৃত্যু ইতিহাসে এক কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে, যেখানে লুকিয়ে ছিল বছরের পর বছর জমে থাকা অন্যায় ও বৈষম্যের চেহারা।

অনুলিখন: ইবতেশাম রহমান সায়নাভ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রুয়া নির্বাচন: বিএনপিপন্থীদের বর্জন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জামায়াতপন্থী ২৭ জন নির্বাচিত

‘পাপ কাহিনী’র হাত ধরে দেশের ওটিটিতে ফিরল অশ্লীলতা

সৌদি আরবের কেনা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে দেওয়ার অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্রের, প্রত্যাখ্যান করে কিসের ইঙ্গিত দিল রিয়াদ

সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, আটক ৫

আগের তিন ভোটের নির্বাচনী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পাবেন না

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত