গোলাম ওয়াদুদ
বাবা-মায়ের অন্যতম চিন্তা থাকে ছেলেমেয়ের পড়ালেখা নিয়ে। সন্তান জন্মের পর থেকেই তাকে পড়তে শেখানোটাকে অনেক বড় করে দেখেন বাবা-মা। কথা বলতে শেখার পরই শুরু হয় পড়তে শেখানোর তোড়জোড়। কোনো কোনো দেশে চার বছর বয়সে বাচ্চারা লিখতে ও পড়তে শেখে। আবার কোনো দেশে সাত বছরের আগে কোনোভাবেই পড়ালেখা শুরু করা হয় না। কেউ বলেন অল্প বয়স থেকেই পড়তে শেখা শুরু করা উচিত, আবার কেউ বলেন একেবারে উল্টো কথা। কোনটি সঠিক?
দেশে এখন প্রি-স্কুল ধারণা বেশ প্রসার পেয়েছে। বিশেষত শহুরে শিশুরা বেশ অল্প বয়সেই গুটি গুটি পায়ে স্কুলে যাচ্ছে। রোজ সকালে অভিভাবকের আঙুল ধরে বাচ্চাদের এমন স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য চোখ মেললেই নজরে পড়ে। সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বদলে প্লে, নার্সারি হয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হওয়াটা এখন শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
যে অভিভাবকের হাত ধরে চার-সাড়ে চার বছরের শিশুটি স্কুলে যাচ্ছে, সেই অভিভাবক হয়তো ছয় কি সাত বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তাহলে পড়াশোনা শুরুর মোক্ষম বয়স সম্পর্কিত ধারণা কি বদলে গেল? একটা বিতর্ক প্রায়ই উঠতে দেখা যায়—শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে। কেউ বলেন, শৈশবেই গুরুত্ব সহকারে পড়তে শেখানোটা জরুরি। আবার কেউ বলেন, আগে শৈশবটা কাটাতে দিতে হবে। বাড়তি চাপ না দিয়ে শিশুকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দিতে হবে। কখনো কখনো আবার অভিভাবকেরা শিশুর পড়াশোনা নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কি-না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি সম্প্রতি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই যে লেখা, কথা, গাওয়া বা উচ্চ স্বরে পড়া আমাদের প্রাথমিক বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাবা-মা সন্তানকে শিশু অবস্থাতেই পড়তে উৎসাহিত করেন। শিশু হিসেবে তাদের সঙ্গে কতটা বেশি বা কম কথা বলা হয়, তা তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা অর্জনের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি শিশুর ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা তাদের পরবর্তী সাফল্যের জন্য মুখ্য প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত। তাই প্রি-স্কুলগুলোতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর আগেই শিশুদের মৌলিক সাক্ষরতার দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়। শিশুরা যখন স্কুল শুরু করে, তখন সাক্ষরতা সব সময়ই একটি প্রধান মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সব শিশু লিখতে ও পড়তে পারে কি-না, তা নিশ্চিত করা এখন বেশি চাপের হয়ে উঠেছে। গবেষকেরা সতর্ক করেছেন, মহামারির প্রভাবে ধনী ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দক্ষতা অর্জনের ব্যবধান বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষা বৈষম্য।
অনেক দেশেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় চার বছর বয়স থেকে। কিছু অভিভাবক এই শিশুদের জন্য আবার অতিরিক্ত প্রাইভেট টিউটরিংয়ের ব্যবস্থাও করেন। তাড়াতাড়ি শুরু করলে শিশুরা শিক্ষাজীবনে দ্রুত এগিয়ে যাবে—এমন চিন্তা থেকেই এটি করা হয়। মূল লক্ষ্য—এ যুগের অস্ত্র ‘শিক্ষা’ দিয়ে সন্তান বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘সশস্ত্র’ করে তোলা, যাতে সে প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারে।
কয়েক দশক আগের খেলাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে তুলনা করলেই এখনকার প্রবণতার সঙ্গে এর নীতিগত ফারাকটা বোঝা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে একটি আইন করে, যেখানে বলা হয় ‘কোনো শিশুকে পেছনে ফেলব না’। এই আইনের পর দেশটিতে শিশুদের তাড়াতাড়ি স্কুলে পাঠানোর প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে শিশুদের বয়স ৫-৬ বছর হলে তারা পড়াশোনার জন্য প্রস্তুত কি-না, তা বুঝতে তাদের পরীক্ষা করা হয়। এই নিয়মের প্রবক্তাদের ভাষ্য, কোন শিশুর অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন, তা এই পদ্ধতিতে শনাক্ত করা যায়। এর সমালোচনাও আছে। সমালোচকদের বক্তব্য, এই পদ্ধতি কিছু শিশুর পড়া বন্ধ করে দিতে পারে।
যা হোক, কিছু গবেষণা বলছে তাড়াতাড়ি অ্যাকাডেমিক পরিবেশে প্রবেশ শিশুদের কিছু সুবিধা দেয়। ২০১৫ সালে একটি মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের কী জানা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সমাজের প্রত্যাশায় পরিবর্তন হয়েছে। তারা খেলাভিত্তিক শিক্ষার বদলে উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষেই শিশুদের পাঠাতে বেশি আগ্রহী।
তাড়াতাড়ি বিদ্যালয়ে পাঠানোর ঝুঁকি
শিশুরা কী এবং কীভাবে শেখে, তা নির্ভর করে শিক্ষার পরিবেশের ওপর। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রাথমিক শিক্ষার অধ্যাপক ডমিনিক ওয়াইস বলেছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো শিশুদের পড়তে শেখা। এটি শিশুদের জীবনে অগ্রগতির জন্য মৌলিক বিষয়।’ডমিনিক ওয়াইস সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালিস ব্র্যাডবারির সঙ্গে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে শিশুদের সাক্ষরতা শেখাই, তা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
২০২২ সালে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইংরেজি স্কুল সিস্টেমে ধ্বনির ওপর যে মনোযোগ দেওয়া হয়, তাতে কিছু বাচ্চা ব্যর্থ হতে পারে। এর কারণ হিসেবে ব্র্যাডবারি বলছেন, তাড়াতাড়ি স্কুলে পাঠানোর ফলে অ্যাকাডেমিক শিক্ষার দিকে ঝোঁক বেড়ে গেছে। কিন্তু শিশুদের পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রাথমিক শিক্ষার বই বা অন্যান্য পাঠ্যবইগুলো পড়া বা উপভোগ করার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা খুবই কম হচ্ছে।
কীভাবে পড়া শেখা উচিত, সে বিষয়ে ডমিনিক ওয়াইস বা ব্র্যাডবারি—কেউই আলোকপাত করেননি। বরং শিশুদের যেভাবে সাক্ষরতা শেখানো হয়, সেটা পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মত দিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, ‘গল্পের বই, গান ও কবিতা ব্যবহার করে শব্দের সঙ্গে শিশুদের পরিচিত ও আগ্রহী করায় উৎসাহিত করা উচিত। এগুলো শিশুকে শব্দ উচ্চারণ করতে, সেই সঙ্গে শব্দভান্ডার প্রসারিত করতে সহায়তা করে।’
প্রি-স্কুলে যোগদান শিশুদের জীবনের পরবর্তী অর্জনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটি অ্যাকাডেমিক দক্ষতার ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজনীয় নয় বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং এটি অত্যধিক অ্যাকাডেমিক চাপ, এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলেও অনেক গবেষক শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে এর স্বপক্ষে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা অ্যাকাডেমিকভাবে জোর দিয়ে প্রি-স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, তারা কয়েক বছর পর খুব কম অ্যাকাডেমিক কৃতিত্ব দেখিয়েছে। অন্যদিকে যারা প্রি-স্কুলে ভর্তি হয়নি বা হতে পারেনি, তারা তাদের চেয়ে ভালো করেছিল।
শিশুকালে খেলাভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্বের ওপর গবেষণা করে দেখা যায়, খেলাভিত্তিক প্রি-স্কুলগুলো অ্যাকাডেমিকভাবে পরিচালিত প্রি-স্কুলগুলোর চেয়ে ভালো ফলাফল করছে। চলতি বছরের এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের সামগ্রিক স্কুলজীবনের সাফল্য তাদের প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা ওপর নির্ভর করে। সমীক্ষার উপসংহারে বলা হয়, শিশুদের খুব তাড়াতাড়ি প্রি-স্কুলে ভর্তি করাটা আসলেই সমস্যার হতে পারে।
পরে শুরু, ভালো ফলাফল
দেখা যাচ্ছে শিশুশিক্ষা সবাই তাড়াতাড়ি শুরুর পক্ষে নন। জার্মানি, ইরান, জাপানসহ অনেক দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় ছয় বছরের দিকে। ফিনল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার দেশ হিসেবে সমাদৃত। সেখানে শিশুরা সাত বছর বয়সে স্কুল শুরু করে।
আপাতদৃষ্টিতে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের থেকে পড়া বোঝার দিক দিয়ে বেশি স্কোর করে। ফিনল্যান্ডের কিন্ডারগার্টেনগুলোতে খেলা ও কিছু আনুষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়।
২০০৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একটি পর্যালোচনা প্রস্তাব করে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল শুরুর বয়স ছয় বছর হওয়া উচিত বলে মত দেওয়া হয়। বলা হয়, তাড়াতাড়ি স্কুলে দিলে পাঁচ বছরের শিশুর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে পারে। তারা শেখার দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ে শিশুরা আগে যে বয়সে ভর্তি হতো, তার চেয়ে এক বছর দেরিতে ভর্তি হওয়ায় তাদের পরীক্ষায় নম্বরের উন্নতি হয়েছে।
তাড়াতাড়ি শুরু করা ও দেরিতে শুরু করা শিশুদের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে, যারা তাড়াতাড়ি শুরু করেছে, তারা দেরিতে শুরু করা শিশুদের থেকে পড়া এবং তা বোঝার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে জার্মানির রেজেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লেখক সেবাস্টিয়ান সুগেট বিবিসিকে বলেন, দেরিতে শেখার ফলে তারা যা শিখছে, তার সঙ্গে তাদের জ্ঞান, বোধগম্যতাকে মিলিয়ে নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি আপনি ভাষায় মনোযোগ দিতে বেশি সময় ব্যয় করেন, তবে আসলে আপনি দক্ষতার একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করছেন, যার বিকাশ ঘটতে কয়েক বছর সময় লাগে। পড়া দ্রুত বাছাই করা যেতে পারে। কিন্তু ভাষার জন্য কোনো সস্তা কৌশল নেই। এটার জন্য দরকার কঠোর পরিশ্রম।’
তাই প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি তাড়াতাড়ি শেখার মাধ্যমে পড়ার ক্ষমতা উন্নত না হয়, তবে তাড়াতাড়ি শুরু করা কেন? মূল লক্ষ্য যদি হয় শিশুকে ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা, তবে তার জন্য যেটা ভালো, সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত। শিশুর সাক্ষরতার জন্য তাড়াহুড়ো না করে, তার প্রবণতার দিকে তাকানোটাই জরুরি। শিশু যদি অল্প বয়সেই পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে, তবে তার সে আগ্রহকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। বিপরীতে তেমন আগ্রহ যদি তার ভেতরে দেখা না যায়, তবে তাকে ধরেবেঁধে পড়ার জগতে না ঢুকিয়ে অপেক্ষা করাটাই ভালো। যেহেতু দ্রুত পাঠ শুরুর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পড়াশোনায় সুফল পাওয়ার তেমন প্রমাণ হাত নেই।
বাবা-মায়ের অন্যতম চিন্তা থাকে ছেলেমেয়ের পড়ালেখা নিয়ে। সন্তান জন্মের পর থেকেই তাকে পড়তে শেখানোটাকে অনেক বড় করে দেখেন বাবা-মা। কথা বলতে শেখার পরই শুরু হয় পড়তে শেখানোর তোড়জোড়। কোনো কোনো দেশে চার বছর বয়সে বাচ্চারা লিখতে ও পড়তে শেখে। আবার কোনো দেশে সাত বছরের আগে কোনোভাবেই পড়ালেখা শুরু করা হয় না। কেউ বলেন অল্প বয়স থেকেই পড়তে শেখা শুরু করা উচিত, আবার কেউ বলেন একেবারে উল্টো কথা। কোনটি সঠিক?
দেশে এখন প্রি-স্কুল ধারণা বেশ প্রসার পেয়েছে। বিশেষত শহুরে শিশুরা বেশ অল্প বয়সেই গুটি গুটি পায়ে স্কুলে যাচ্ছে। রোজ সকালে অভিভাবকের আঙুল ধরে বাচ্চাদের এমন স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য চোখ মেললেই নজরে পড়ে। সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বদলে প্লে, নার্সারি হয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হওয়াটা এখন শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
যে অভিভাবকের হাত ধরে চার-সাড়ে চার বছরের শিশুটি স্কুলে যাচ্ছে, সেই অভিভাবক হয়তো ছয় কি সাত বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তাহলে পড়াশোনা শুরুর মোক্ষম বয়স সম্পর্কিত ধারণা কি বদলে গেল? একটা বিতর্ক প্রায়ই উঠতে দেখা যায়—শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে। কেউ বলেন, শৈশবেই গুরুত্ব সহকারে পড়তে শেখানোটা জরুরি। আবার কেউ বলেন, আগে শৈশবটা কাটাতে দিতে হবে। বাড়তি চাপ না দিয়ে শিশুকে নিজের মতো বেড়ে উঠতে দিতে হবে। কখনো কখনো আবার অভিভাবকেরা শিশুর পড়াশোনা নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কি-না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যান।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি সম্প্রতি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, কোনো সন্দেহ নেই যে লেখা, কথা, গাওয়া বা উচ্চ স্বরে পড়া আমাদের প্রাথমিক বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাবা-মা সন্তানকে শিশু অবস্থাতেই পড়তে উৎসাহিত করেন। শিশু হিসেবে তাদের সঙ্গে কতটা বেশি বা কম কথা বলা হয়, তা তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা অর্জনের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি শিশুর ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা তাদের পরবর্তী সাফল্যের জন্য মুখ্য প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত। তাই প্রি-স্কুলগুলোতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর আগেই শিশুদের মৌলিক সাক্ষরতার দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়। শিশুরা যখন স্কুল শুরু করে, তখন সাক্ষরতা সব সময়ই একটি প্রধান মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সব শিশু লিখতে ও পড়তে পারে কি-না, তা নিশ্চিত করা এখন বেশি চাপের হয়ে উঠেছে। গবেষকেরা সতর্ক করেছেন, মহামারির প্রভাবে ধনী ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দক্ষতা অর্জনের ব্যবধান বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষা বৈষম্য।
অনেক দেশেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় চার বছর বয়স থেকে। কিছু অভিভাবক এই শিশুদের জন্য আবার অতিরিক্ত প্রাইভেট টিউটরিংয়ের ব্যবস্থাও করেন। তাড়াতাড়ি শুরু করলে শিশুরা শিক্ষাজীবনে দ্রুত এগিয়ে যাবে—এমন চিন্তা থেকেই এটি করা হয়। মূল লক্ষ্য—এ যুগের অস্ত্র ‘শিক্ষা’ দিয়ে সন্তান বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘সশস্ত্র’ করে তোলা, যাতে সে প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারে।
কয়েক দশক আগের খেলাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে তুলনা করলেই এখনকার প্রবণতার সঙ্গে এর নীতিগত ফারাকটা বোঝা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে একটি আইন করে, যেখানে বলা হয় ‘কোনো শিশুকে পেছনে ফেলব না’। এই আইনের পর দেশটিতে শিশুদের তাড়াতাড়ি স্কুলে পাঠানোর প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে শিশুদের বয়স ৫-৬ বছর হলে তারা পড়াশোনার জন্য প্রস্তুত কি-না, তা বুঝতে তাদের পরীক্ষা করা হয়। এই নিয়মের প্রবক্তাদের ভাষ্য, কোন শিশুর অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন, তা এই পদ্ধতিতে শনাক্ত করা যায়। এর সমালোচনাও আছে। সমালোচকদের বক্তব্য, এই পদ্ধতি কিছু শিশুর পড়া বন্ধ করে দিতে পারে।
যা হোক, কিছু গবেষণা বলছে তাড়াতাড়ি অ্যাকাডেমিক পরিবেশে প্রবেশ শিশুদের কিছু সুবিধা দেয়। ২০১৫ সালে একটি মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের কী জানা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সমাজের প্রত্যাশায় পরিবর্তন হয়েছে। তারা খেলাভিত্তিক শিক্ষার বদলে উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষেই শিশুদের পাঠাতে বেশি আগ্রহী।
তাড়াতাড়ি বিদ্যালয়ে পাঠানোর ঝুঁকি
শিশুরা কী এবং কীভাবে শেখে, তা নির্ভর করে শিক্ষার পরিবেশের ওপর। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রাথমিক শিক্ষার অধ্যাপক ডমিনিক ওয়াইস বলেছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো শিশুদের পড়তে শেখা। এটি শিশুদের জীবনে অগ্রগতির জন্য মৌলিক বিষয়।’ডমিনিক ওয়াইস সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালিস ব্র্যাডবারির সঙ্গে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেভাবে শিশুদের সাক্ষরতা শেখাই, তা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
২০২২ সালে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইংরেজি স্কুল সিস্টেমে ধ্বনির ওপর যে মনোযোগ দেওয়া হয়, তাতে কিছু বাচ্চা ব্যর্থ হতে পারে। এর কারণ হিসেবে ব্র্যাডবারি বলছেন, তাড়াতাড়ি স্কুলে পাঠানোর ফলে অ্যাকাডেমিক শিক্ষার দিকে ঝোঁক বেড়ে গেছে। কিন্তু শিশুদের পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রাথমিক শিক্ষার বই বা অন্যান্য পাঠ্যবইগুলো পড়া বা উপভোগ করার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন, সেটা খুবই কম হচ্ছে।
কীভাবে পড়া শেখা উচিত, সে বিষয়ে ডমিনিক ওয়াইস বা ব্র্যাডবারি—কেউই আলোকপাত করেননি। বরং শিশুদের যেভাবে সাক্ষরতা শেখানো হয়, সেটা পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মত দিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, ‘গল্পের বই, গান ও কবিতা ব্যবহার করে শব্দের সঙ্গে শিশুদের পরিচিত ও আগ্রহী করায় উৎসাহিত করা উচিত। এগুলো শিশুকে শব্দ উচ্চারণ করতে, সেই সঙ্গে শব্দভান্ডার প্রসারিত করতে সহায়তা করে।’
প্রি-স্কুলে যোগদান শিশুদের জীবনের পরবর্তী অর্জনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটি অ্যাকাডেমিক দক্ষতার ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজনীয় নয় বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং এটি অত্যধিক অ্যাকাডেমিক চাপ, এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলেও অনেক গবেষক শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে এর স্বপক্ষে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা অ্যাকাডেমিকভাবে জোর দিয়ে প্রি-স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, তারা কয়েক বছর পর খুব কম অ্যাকাডেমিক কৃতিত্ব দেখিয়েছে। অন্যদিকে যারা প্রি-স্কুলে ভর্তি হয়নি বা হতে পারেনি, তারা তাদের চেয়ে ভালো করেছিল।
শিশুকালে খেলাভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্বের ওপর গবেষণা করে দেখা যায়, খেলাভিত্তিক প্রি-স্কুলগুলো অ্যাকাডেমিকভাবে পরিচালিত প্রি-স্কুলগুলোর চেয়ে ভালো ফলাফল করছে। চলতি বছরের এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের সামগ্রিক স্কুলজীবনের সাফল্য তাদের প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা ওপর নির্ভর করে। সমীক্ষার উপসংহারে বলা হয়, শিশুদের খুব তাড়াতাড়ি প্রি-স্কুলে ভর্তি করাটা আসলেই সমস্যার হতে পারে।
পরে শুরু, ভালো ফলাফল
দেখা যাচ্ছে শিশুশিক্ষা সবাই তাড়াতাড়ি শুরুর পক্ষে নন। জার্মানি, ইরান, জাপানসহ অনেক দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় ছয় বছরের দিকে। ফিনল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার দেশ হিসেবে সমাদৃত। সেখানে শিশুরা সাত বছর বয়সে স্কুল শুরু করে।
আপাতদৃষ্টিতে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের থেকে পড়া বোঝার দিক দিয়ে বেশি স্কোর করে। ফিনল্যান্ডের কিন্ডারগার্টেনগুলোতে খেলা ও কিছু আনুষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়।
২০০৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একটি পর্যালোচনা প্রস্তাব করে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল শুরুর বয়স ছয় বছর হওয়া উচিত বলে মত দেওয়া হয়। বলা হয়, তাড়াতাড়ি স্কুলে দিলে পাঁচ বছরের শিশুর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে পারে। তারা শেখার দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ে শিশুরা আগে যে বয়সে ভর্তি হতো, তার চেয়ে এক বছর দেরিতে ভর্তি হওয়ায় তাদের পরীক্ষায় নম্বরের উন্নতি হয়েছে।
তাড়াতাড়ি শুরু করা ও দেরিতে শুরু করা শিশুদের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে, যারা তাড়াতাড়ি শুরু করেছে, তারা দেরিতে শুরু করা শিশুদের থেকে পড়া এবং তা বোঝার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে জার্মানির রেজেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লেখক সেবাস্টিয়ান সুগেট বিবিসিকে বলেন, দেরিতে শেখার ফলে তারা যা শিখছে, তার সঙ্গে তাদের জ্ঞান, বোধগম্যতাকে মিলিয়ে নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি আপনি ভাষায় মনোযোগ দিতে বেশি সময় ব্যয় করেন, তবে আসলে আপনি দক্ষতার একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করছেন, যার বিকাশ ঘটতে কয়েক বছর সময় লাগে। পড়া দ্রুত বাছাই করা যেতে পারে। কিন্তু ভাষার জন্য কোনো সস্তা কৌশল নেই। এটার জন্য দরকার কঠোর পরিশ্রম।’
তাই প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি তাড়াতাড়ি শেখার মাধ্যমে পড়ার ক্ষমতা উন্নত না হয়, তবে তাড়াতাড়ি শুরু করা কেন? মূল লক্ষ্য যদি হয় শিশুকে ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা, তবে তার জন্য যেটা ভালো, সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত। শিশুর সাক্ষরতার জন্য তাড়াহুড়ো না করে, তার প্রবণতার দিকে তাকানোটাই জরুরি। শিশু যদি অল্প বয়সেই পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে, তবে তার সে আগ্রহকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। বিপরীতে তেমন আগ্রহ যদি তার ভেতরে দেখা না যায়, তবে তাকে ধরেবেঁধে পড়ার জগতে না ঢুকিয়ে অপেক্ষা করাটাই ভালো। যেহেতু দ্রুত পাঠ শুরুর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পড়াশোনায় সুফল পাওয়ার তেমন প্রমাণ হাত নেই।
ওমানের সুলতান সরকার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য, ফুল ফান্ডেড বা সম্পূর্ণ অর্থায়িত স্কলারশিপের ঘোষণা দিয়েছে। এই স্কলারশিপের অধীনে শিক্ষার্থীরা ‘ওমানি প্রোগ্রাম ফর কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক কো-অপারেশন’-এর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
২ ঘণ্টা আগেমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার আওতাধীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন (eSIF পূরণের মাধ্যমে) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়া চলবে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
৬ ঘণ্টা আগেবিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি) তিন দিনব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল মডেল ইউনাইটেড নেশনস (বিইউএফটিআইমান) কনফারেন্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই আয়োজন চলবে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত।
২০ ঘণ্টা আগেইতালির ইউনিভার্সিটি অব পিসা স্কলারশিপ-২০২৬-এর আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো দেশের শিক্ষার্থীরা এ বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। সম্পূর্ণ অর্থায়িত এ বৃত্তির আওতায় শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পাবেন।
১ দিন আগে