Ajker Patrika

রাবির ‘মনোনীত প্রশাসনে’ বেপরোয়া ছাত্রলীগ

রিপন চন্দ্র রায়, রাবি
আপডেট : ১৯ মে ২০২৪, ০৯: ৪০
রাবির ‘মনোনীত প্রশাসনে’ বেপরোয়া ছাত্রলীগ

প্রায় সাত বছর পর গত অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। এর পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একের পর এক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, হলের সিট দখল, সিট থেকে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়া, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মতো অপরাধকর্মের অভিযোগ উঠছে তাঁদের বিরুদ্ধে।

কিছুদিন পরপর এমন ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দায়ী করছেন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে আসেননি। তাঁরা মূলত মনোনীত প্রশাসন। কারও না কারও মন জুগিয়ে তাঁরা প্রশাসনে এসেছেন। ফলে তাঁদের অনুসারী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের নেই। আর তাঁদের এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রশাসন একেবারেই নিষ্ক্রিয় নয়। বিভিন্ন ঘটনায় শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কয়েকজনকে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে।

তবে এসব ঘটনা দীর্ঘদিনের মন্দ চর্চার ফল। তাই চাইলেও রাতারাতি তা সমাধান করা সম্ভব নয়।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব বলেন, ‘কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়ামাত্রই আমরা বিষয়টি সমাধান করে দিই। তার পরেও যদি কেউ কোনো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

এক সপ্তাহে যত ঘটনা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ মে রাতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের অতিথিকক্ষে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। রাতভর চলে সেই সংঘর্ষ। এ ঘটনায় হলের একটি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।

পরদিন ১২ মে সকালে হলের এক নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর করেন ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এক দিন পর আবার হলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হাতে রড, রামদা, লাঠিসোঁটাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন। সে ঘটনার খবর ও ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর পরও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে অস্ত্র দেখেননি বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। ঘটনাটি তদন্তে হল প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তারা নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে গাঁজা সেবনে নিষেধ করায় দুই শিক্ষার্থীকে মারধর ও একটি দোকান ভাঙচুর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর আগের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের এক শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে তুলে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আর গত বুধবার রাতে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।

ছয় মাসে যত অভিযোগ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ নভেম্বর শহীদ হবিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নিকল রায়কে হুমকি ও শারীরিক নির্যাতন করে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিনহাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ১৮ ডিসেম্বর নবাব আব্দুল লতিফ হলের আবাসিক ছাত্র মফিজুর রহমানকে মারধর ও হল থেকে নেমে যাওয়ার হুমকির অভিযোগ ওঠে। গত ৬ মার্চ ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের চার নেতার বিরুদ্ধে। এরপর গত ১২ মার্চ ক্যাম্পাসের একটি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানির কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন দুই নেতা।

এ ছাড়া গত ১৩ নভেম্বর রাতে নবাব আব্দুল লতিফ হলে এক ছাত্রলীগের কর্মীকে হলের সিট থেকে নামিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর কয়েক দিন পরেই মতিহার হলের ক্যানটিনে বসাকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে ৩ দফা মারামারির ঘটনা ঘটে। গত ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মাদার বখ্শ হলগেটে হাতাহাতির ঘটনায় ছাত্রলীগের একপক্ষের নেতা-কর্মীদের হাতে রড ও লাঠিসোঁটা দেখা যায়।

১ মে শাহ্ মখদুম হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবীউল হাসান অপূর্বের সিট দখল ও তাঁকে হত্যার হুমকির অভিযোগ ওঠে দুই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। ৬ মে রাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাফিউল ইসলাম জীবন ও তাঁর বন্ধু ইউনুস খানকে মাদার বখ্শ হলে আটকে মারধর, পিস্তল ঠেকিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

এত সব অভিযোগ ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী এই প্রশাসন নির্বাচিত নয়। কারও না কারও মন জুগিয়ে তারা মনোনীত হয়েছে। ফলে তাদেরই অনুসারী ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। আর সংগঠনে যখন সাংগঠনিক চর্চা থাকে না, অছাত্ররা বেশি সক্রিয় হয়, তখন তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।’

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘এ ধরনের অপকর্ম যারা করছে, তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারাও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর দায় অবশ্যই প্রশাসনের।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসন তাদের এসব কুকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। এ ধরনের একটা মনোভাব ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আছে। এসব কারণেই মূলত তাদের অন্যায় ও অপকর্ম করার প্রবণতা বেড়েছে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি, কিন্তু নিতে গেলেই অপরাধীরা খুব বড় রকমের সুপারিশ নিয়ে হাজির হয়। আবার ব্যবস্থা নিতে গেলে অভিযোগ লাগে এবং তা প্রমাণে সাক্ষীও লাগে। কিন্তু অভিযোগ পেলেও সাক্ষী পাই না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত