Ajker Patrika

আড়াই লাখে আইইএলটিএসের প্রশ্ন ফাঁসের ফাঁদ

আল-আমিন রাজু, ঢাকা
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ২১: ১৫
Thumbnail image

ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম (আইইএলটিএস) বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা। ইংরেজি বিষয়ে কার কেমন দক্ষতা রয়েছে, তা মূল্যায়ন করতে এই পরীক্ষা নেওয়া হয়। রিডিং, রাইটিং, লিসেনিং, স্পিকিং—এসব বিষয়ের ভিত্তিতে এই পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন করা হয়। ইউরোপসহ বিশ্বের ‍উন্নত দেশগুলোতে বৈধভাবে পড়াশোনা ও কাজের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

তবে কোনো ধরনের দক্ষতা ছাড়াই মাত্র আড়াই লাখ টাকায় মিলছে আইইএলটিএসের প্রশ্ন! শুধু তা-ই নয়, দেওয়া হচ্ছে ন্যূনতম সাড়ে ৭ স্কোর পাওয়ার নিশ্চয়তা। অনলাইনে পরীক্ষার্থীদের প্রলোভন দেখিয়ে এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। 

চক্রের অন্যতম হোতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর এলাকার মো. খালেক চৌধুরীর ছেলে রেদুওয়ান চৌধুরী। মাত্র ২২ বছরের এই তরুণের দাবি, তিনি আইইএলটিএস পাসের শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারেন। আর এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। বিকাশসহ নিজের নামে খোলা দুই বেসরকারি ব্যাংকে লেনদেনের তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে।

রাজধানীতে কোচিং সেন্টার খুলে পড়াশোনা ছাড়াই প্রশ্ন পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছেন রেদুওয়ান। পরীক্ষা শুরুর ছয় ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। চক্রটির মাধ্যমে অনেকে আইইএলটিএস পরীক্ষায় ভালো স্কোর করেছেন বলেও প্রচার করা হচ্ছে। 

ধানমন্ডিতে নিজ অফিসে বসে এক আইইএলটিএস পরীক্ষার্থীকে এসব কথাই বলেন রেদুওয়ান চৌধুরী। তিনি ফেসবুকে স্টাডি স্পার্ক ইন্টারন্যাশনাল ও ভিসাপাথ এডুকেশন নামে দুটি পেজ চালান। 

একজন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ আলাপের স্ক্রিনশট আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। কথোপকথনে চলতি বছরের ২৫ জুলাই পরীক্ষার প্রশ্ন পাঠিয়ে মিলিয়ে নিতে বলেন রেদুওয়ান। টাস্ক ১ ও টাস্ক ২-এ কী প্রশ্ন এসেছে, সেটিও উল্লেখ করে দেন।

এক পরীক্ষার্থীর স্বজনের সঙ্গে আলাপের একটি ভিডিও ক্লিপও আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। যেখানে অকপটেই রেদুওয়ান জানাচ্ছেন প্রশ্ন ফাঁসের বিস্তারিত তথ্য। এমনকি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন, বাকি টাকা দিলেই পরীক্ষায় বসতে পারবে বলে জানান তিনি। 

ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে দেশের বাইরে থেকে করা হয় আইইএলটিএসের প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন ফাঁস করার ঘটনা কখনো শোনা যায়নি। তাহলে রেদুওয়ান আসলে কী করছেন, সেটি জানতে এক নারীর সহযোগিতা নেওয়া হয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বিধবা এক সন্তানের মা পরিচয় দেওয়া ওই নারী রেদুওয়ানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। পরীক্ষা দিয়ে দ্রুত ইউরোপের একটি দেশে যেতে চান বলে জানান তিনি। পরে তাঁর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ধানমন্ডির শংকর এলাকার চেয়ারম্যান গলিতে দুই কক্ষের অফিসে যান। এ সময় সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে নারীর স্বজন পরিচয়ে এই প্রতিবেদকও অফিসে প্রবেশ করেন।

ভিসাপাথ এডুকেশন ও স্টাডি স্পার্ক ইন্টারন্যাশনাল নামে ফেসবুক পেজ খুলেছেন রেদুওয়ান।একটি টেবিল ও কিছু চেয়ার দিয়ে কোচিং সেন্টারের আদলে সাজানো একটি কক্ষ। ভেতরের কক্ষে পরিপাটি টেবিল, চেয়ার ও সোফা দিয়ে সাজানো। অফিস ‍রুমে গিয়ে দেখা যায়, আরও অনেকে এসেছেন। পড়াশোনা ছাড়াই পরীক্ষা দিতে চান তাঁরা। টাকা নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। টাকার বিনিময়ে আইইএলটিএসে সাতের বেশি (সাড়ে আট) স্কোর পাওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন রেদুওয়ান। তাঁর সঙ্গে ছদ্মবেশী নারীসহ উপস্থিত কয়েকজনের আলোচনার রেকর্ড আজকের পত্রিকার হাতে রয়েছে। 

ছদ্মবেশী নারীকে রেদুওয়ান বলেন, পরীক্ষায় বসতে হলে আড়াই লাখ টাকা দিতে হবে। রিডিং, রাইটিং, লিসেনিংয়ে শতভাগ নিশ্চয়তা। তবে স্পিকিংয়ের নিশ্চয়তা তিনি দেবেন না। অবশ্য এই চারটি মডিউল ছাড়াও ১৫ লাখ টাকায় সনদ দিতে পারেন তিনি। পরীক্ষার দিন সকাল ৬টায় প্রশ্ন পাওয়া যাবে। শতভাগ নিশ্চয়তা আছে। যদি পরীক্ষার সময় এক ভাগ প্রশ্ন না মেলে, তাহলে আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা বসতে পারবে। সাড়ে ৮ স্কোর পাওয়ার নিশ্চয়তা দেন তিনি।

উপস্থিত সবাইকে আশ্বস্ত করতে রেদুওয়ান বলেন, ‘আমি মাত্র ২২ বছর বয়সে যা আয় করেছি, তা দিয়ে আগামী ১০০ বছর বসে খেতে পারব!’ 

দীর্ঘ আলাপ শেষে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আইইএলটিএসের প্রশ্ন ফাঁস কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে রেদুওয়ান এতক্ষণের সব আলাপ অস্বীকার করেন। তখন ভিডিও ও অডিও রেকর্ড দেখালে বলেন, তিনি এসব বলেননি।

এই সময়ে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকার এক ভুক্তভোগী হাজির হন। প্রথমে তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। পরে টাকা দেওয়ার প্রমাণ দেখালে বলেন, ‘২০ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন করার জন্য নিয়েছি।’

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এই শিক্ষার্থী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফেসবুকের মাধ্যমে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করি। কিন্তু রেদুওয়ানের এই অফিসে আসার পরে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ জন্য তাঁকে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে বিকাশ, ব্যাংকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু এই টাকা পেয়ে আরও ১ লাখ টাকা দাবি করেন। এখন আমার পরিবার বিষয়টি জেনে যাওয়ায় টাকা তুলে নিতে বলে। কিন্তু সেই টাকা ফেরত না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিত।’

এ ঘটনাগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইইএলটিএস একটি আন্তর্জাতিক পরীক্ষা। দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীরা এই পরীক্ষায় অংশ নিতে অনেক পড়াশোনা করেন। কোচিং করেন। নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা ব্যয় করেন। এই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের যে কথা শোনা যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। না হলে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন আসবে।’

আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব কি না—জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা একেবারে অসম্ভব। আমরা কাজ করছি। কাউকে এই পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া হবে না।’

আজ রোববার জানা গেছে, ভুক্তভোগী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী রেদুওয়ানকে আসামি করে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেছেন। বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছে ডিবি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু, সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার

রাজধানীর প্রেসক্লাব এলাকায় লিফলেট বিতরণ করল আ.লীগ

‘মধ্যমপন্থী’ দল গড়ছেন অভ্যুত্থানের নেতারা, আলোচনায় ইলিশ প্রতীক

লিবিয়ার সৈকতে ২০ জনের গলিত লাশ, সবাই বাংলাদেশি বলে ধারণা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু, বিচার চাইল বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত