Ajker Patrika

সার জমি নদী গিলছে পোটন

রাশেদ নিজাম, নরসিংদী থেকে ফিরে
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ০৯
Thumbnail image

শিক্ষায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও দখলদারিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সরকারি সার, নদীর তীর, অন্যের জমিসহ অনেক কিছুই তিনি দখল করেছেন। এলাকার সবাই জানলেও ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। তবে ৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার আত্মসাৎ করার খবর প্রকাশের পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। দখলবাজ এই ব্যক্তি হলেন নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান (পোটন)।

ভুক্তভোগী ছাড়াও পোটনের একসময়ের কাছের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদীর পলাশে পোটন অন্তত চারটি বিশাল আকারের জমি দখল করেছেন। সবচেয়ে ছোট জমিটির আয়তন প্রায় ৫০ বিঘা। শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে লাগিয়েছেন সাইনবোর্ড। নামমাত্র মূল্যে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩০ পরিবারের জমি।

নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, পোটন আগে জাতীয় পার্টি করতেন। পরে বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি হন।

জানা যায়, ১৯৯৬ সালের সার কেলেঙ্কারির সময়ও পোটন অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়েছিলেন। পরে পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কামরুল আশরাফ খান পোটনের নম্বরে ফোন করে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠালেও উত্তর মেলেনি। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

কামরুল আশরাফ খান (পোটন)উত্থান যেভাবে: বাবা আশরাফ উদ্দিন খান (তারা মিয়া) ছিলেন পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বড় ভাই আনোয়ারুল আশরাফ খান (দিলীপ) বর্তমানে নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের এমপি।

দীর্ঘদিন তাঁদের সার ব্যবসায়
জড়িত থাকা একজন জানান, পোটনের মেজ ভাই ইফতেখার উদ্দিন খান (লিটন) ওমানে প্রবাসজীবন কাটিয়ে ১৯৯৩ সালে দেশে আসেন। পলাশের বড় সার ব্যবসায়ী বেনু মিয়ার প্রতিষ্ঠান ইউরেকায় কাজ নেন লিটন। পরে খান ট্রেডার্স নামে নিজেই ব্যবসা খোলেন। সঙ্গে রাখেন পোটনকে। কারণ, আশরাফ উদ্দিন খান মারা যাওয়ার পর দুই দফা ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন পোটন। লিটনের টাকা আর পোটনের প্রভাব কাজে লাগিয়ে দ্রুত তাঁরা নিয়ন্ত্রণ নেন সার ব্যবসার।

স্থানীয় দুজন প্রবীণ রাজনীতিক জানান, ১৯৯১ সাল থেকে পোটন ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসের পুরোনো আসবাব নিলামে কিনে পরে রং লাগিয়ে বেচতেন। তাতেও চাতুরীর আশ্রয় নেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিলেন, পরিবারসহ বিদেশ চলে যাবেন, তাই কম দামে বাসার আসবাব বেচে দেবেন। ১৯৯৬ সালে দেশব্যাপী সারের সংকটকালে নরসিংদীতে খান ট্রেডার্সের গুদামে ছিল প্রায় ২০ হাজার টন ইউরিয়া। ১৮৬ টাকা ২৫ পয়সার বস্তা ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। একপর্যায়ে সারের ডিলারদের ধরপাকড় শুরু হলে লিটন ও পোটন ভারতে পালিয়ে যান। মাসতিনেক পর বিএনপির তখনকার মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াকে ম্যানেজ করে তাঁরা দেশে ফেরেন। কিছুদিন পরই ঢাকামুখী হয়ে যান পোটন। টয়েনবি সার্কুলার রোডে অফিস নিয়ে পোটন ট্রেডার্স নামে শুরু করেন সার পরিবহন ব্যবসা।

এমপি হয়ে দখল করেন ৪০০ বিঘা জমিএমপি হয়েই দখলবাজি: ঘোড়াশাল পৌরসভার রাস্তা ধরে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে পাইকসা এলাকায় ওমেরা গ্যাস, প্রাণ, জনতা জুট মিলসসহ বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যদিও এলাকাটির নাম হয়ে গেছে এমপি লাইন। সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রাণের পার্কিং। এর সামনে বড় সাইনবোর্ড লেখা, ‘এই সম্পত্তির মালিক আলহাজ্ব কামরুল ইসলাম খান (পোটন) এমপি’। স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রাচীরঘেরা জায়গাটির পরিমাণ ৫০ বিঘার বেশি।

পাশেই একটি জমিতে বালু তোলার কাজ করছিলেন মঞ্জুর মোরশেদ লিটন (৫৫)। তিনি জানান, এমপি থাকাকালে পোটন প্রথমে কিছু জমি কেনেন। তারপর শুরু করেন দখল। মঞ্জুর মোরশেদ লিটনের বাবা হেলাল উদ্দিন ও চাচা কুদ্দুস আলীর সাড়ে ১৩ শতাংশ জমি ছিল, যার দাম প্রায় ১ কোটি টাকা। প্রথমে স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকায় কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। রাজি না হওয়ায় পোটন জমি দখল করে নেন। লিটন বলেন, ‘হ্যারা প্রশাসন আর ক্যাডার দিয়া আমাদের জায়গাডা দহল কইরা নিছে। হেগো যেই শক্তি, আমরা অনেক দৌড়াদৌড়ি করছিলাম; কিন্তু কোনো সাহায্য পাই নাই। বাধ্য হইয়া জায়গা ছাইড়া দিতে অইছে।’

আরেক ভুক্তভোগী হেমায়েত (৪০) জানান, তাঁদের পরিবারের ৩৩ শতাংশ জায়গা নিয়ে গেছেন পোটন। তাঁদের চার ভাইয়ের নামে ছিল ৮ শতাংশ জমি। ২৪ লাখ টাকায় কেনার কথা বলে রেজিস্ট্রি করার পর দেওয়া হয় মাত্র ৮০ হাজার টাকা। তা প্রত্যাখ্যান করায় পরে কোনো টাকা ছাড়াই জমি দখল করে নেন পোটনের লোকজন।

জোর করে মানুষের ও নদীর জায়গা দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে আসেনি। নদীর জায়গা দখলের বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না। যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করবে।

টয়েনবি সার্কুলার রোডে অফিস নিয়ে ‘পোটন ট্রেডার্স’ নামে সার পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন কামরুল আশরাফ খান (পোটন)দেশছাড়া হিন্দু পরিবার: ঘোড়াশালের ধলাদিয়া দিগদা এলাকায় প্রায় ১৩০ বিঘা জমি পোটনের দখলে। এমপি থাকাকালে পোটন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০টি পরিবারের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে জোর করে ওই জমি কিনে নেন। পরিবারগুলো ভয়ে ভারতে চলে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘এমপি সাবের পক্ষ থেকে প্রথমে কইছে ১ লাখ করে টেহা দিব প্রতি ডিসিমিলের লাইগা। কাগজ কইরা নেওনের পরে দিছে ৩০ হাজার কইরা।’

হিন্দুধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তির দিগদায় জমি ছিল। কিন্তু পোটনের কাছে অসহায় হয়ে পরে পাশের এলাকায় গিয়ে বাড়ি করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুরা এলাকায় এমপিগো লোকজন। আমরা হিন্দু মানুষ, প্রতিবাদ করার সাহস নাই। যেই কয় টেহা দিছে, হেইডা দিয়ে এহানে ঘর উঠাইয়া থাকতাছি।’

নরসিংদী-২ আসনের এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের দাবি, সহোদরের জবরদখলের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। গত ১০ এপ্রিল তিনি বলেন, জমি দখলের বিষয়ে তিনি কিছু শোনেননি। তাঁর কাছে কেউ অভিযোগও দেয়নি।

সার আত্মসাতের তদন্ত: ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আমদানি করা ইউরিয়া সার খালাস করার পর সরকারি গুদামে পৌঁছানোর কাজ পেয়েছিল পোটনের মালিকানাধীন পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। পোটন ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল ইস্যু করেন। এর ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে দুদক গত ৪ এপ্রিল বিসিআইসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে। তাতে দুটি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনসহ সার পরিবহনের চুক্তির নথিপত্র চাওয়া হয় ১২ এপ্রিলের মধ্যে। দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, এখনো চিঠির জবাব আসেনি।

কঠোর অবস্থানে থাকার দাবি শিল্পসচিবের: বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি চেয়ে গত ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বিসিআইসি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে যাবতীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে বিসিআইসিকে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সার পৌঁছে দেওয়ার জন্য পোটন ট্রেডার্সকে আমরা সময় দিয়েছিলাম, তারা পারেনি। এখন আমরা কঠোর অবস্থানে। বিসিআইসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিধি মোতাবেক জরিমানা ও মামলা করা হয়েছে।’

বিএডিসির জেনারেল ম্যানেজার (সার ব্যবস্থাপনা) আবদুল হালিম বলেন, ‘আমরা নভেম্বরে পোটন ট্রেডার্সকে কালোতালিকাভুক্ত করি এবং তাদের এবার কাজ দেওয়া হয়নি। তারা বারবার সার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনেছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত