Ajker Patrika

সৌদি ভিসা প্রক্রিয়া: নেপথ্যে ১৫০ কোটির বাণিজ্য

সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১১: ০২
Thumbnail image

অভাব ঘোচাতে প্রতিবছর সৌদি আরবে যাচ্ছেন লাখ লাখ নারী-পুরুষ। তাঁদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত। তাঁদের এই রুটি-রুজিকে পুঁজি করে শত শত কোটি টাকা পকেটে ভরার চেষ্টায় ব্যস্ত একাধিক চক্র। মরুর দেশটি থেকে সস্তায় নিয়োগপত্র কিনে চড়া দামে গরিব কর্মীদের গছিয়ে দিতে সব পক্ষ এককাট্টা হলেও স্বার্থ নিয়ে বিরোধও দেখা যায় মাঝেমধ্যে।

সর্বশেষ সেই বিরোধ শুরু হয়েছে দুই রিক্রুটিং এজেন্সির নেতৃত্বে ২৪টি এজেন্সির একটি মোর্চার মাধ্যমে সৌদি আরবে লোক পাঠানো এবং ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সিন্ডিকেট গড়ে তোলার পর। দুই রিক্রুটিং এজেন্সির একটি এক মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন, অন্যটি এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের কনস্যুলার শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ‘শাপলা সেন্টার’ নামের একটি ‘ভিসা প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র’ খোলা হয়। এই দলে কয়েকজন সৌদি নাগরিকও আছেন। দূতাবাসের একই শাখার কয়েকজন কর্মচারী সৌদিগামী কর্মীদের ভিসার জন্য পাসপোর্ট সেই সেন্টারে জমা দিতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নির্দেশ দেয়। শুধু তা-ই নয়, সৌদি দূতাবাসের লেটারহেডে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ১৫ অক্টোবর থেকে কর্মীদের পাসপোর্ট শাপলা সেন্টারে গ্রহণ করা হবে। আবার রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত শাপলা সেন্টার থেকে এজেন্সিগুলোকে জানানো হয়, প্রতি পাসপোর্টে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য তিন হাজার টাকা প্রসেসিং ফি দিতে হবে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে এখন প্রতিবছর পাঁচ লাখের বেশি কর্মী সৌদি আরবে যান। প্রতি পাসপোর্ট প্রসেসিংয়ের জন্য তিন হাজার টাকা নিলে বছরে কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকা আয় হবে এই খাত থেকে।

এই চিঠি দেওয়ার পর রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ) নেতৃত্বের একাংশ রোববার থেকে দূতাবাসে এবং ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণাধীন শাপলা সেন্টারে পাসপোর্ট জমা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তারা সংগঠনের সব সদস্যকে চিঠি দিয়ে তা জানিয়ে দেয়। গত শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে বায়রার এক জরুরি সভায় এই ঘোষণা দেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার। তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার একজন নেতা। তবে বায়রা সভা করে আকস্মিকভাবে এমন কঠোর অবস্থান নেওয়ায় কর্মীদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণ এবং কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অচলাবস্থার আশঙ্কা দেখা দেয়।

সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দাহিলান দূতাবাস থেকে ৭ অক্টোবর জারি করা এক বিজ্ঞপ্তির উল্লেখ করে আজকের পত্রিকাকে বলেন, শাপলা সেন্টারের মাধ্যমে কোনো পাসপোর্ট দূতাবাস গ্রহণ করছে না।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বলা হয়, দূতাবাসের নতুন নিয়ম অনুযায়ী কর্মী হিসেবে সৌদি আরবগামী ব্যক্তিদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য পাসপোর্ট গ্রহণ ও ফেরত দেওয়া দূতাবাসেই করা হবে, শাপলা সেন্টারে নয়। পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বহাল থাকবে।

এরপর এ নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শে বায়রার শীর্ষ নেতারা গতকাল রোববার রাষ্ট্রদূত ঈসার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এই সাক্ষাতের পর বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, দূতাবাস তাদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের কাজ যেকোনো সংস্থাকে দিতে পারে। অন্য অনেক দূতাবাস এই ব্যবস্থা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিএফএসের মতো অনেক সংগঠন এ ধরনের কাজ করছে। বায়রা থেকে রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্ব কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি বা এজেন্সির গ্রুপের পরিচালনাধীন গ্রুপকে কোনোক্রমেই দেওয়া না হয়। দূতাবাসে ঝামেলা ও ভিড় এড়াতে বাংলাদেশের কোনো সংস্থাকে যদি ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্ব দিতেই হয়, তা যেন বায়রা অথবা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, অথবা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়, সে বিষয়েও রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করা হয়েছে। নোমান আরও জানান, রাষ্ট্রদূত এ বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন বলে বায়রাকে আশ্বস্ত করেছেন।

সৌদিগামী কর্মীদের পাসপোর্টে ভিসা দেওয়া নিয়ে চক্রগুলো এই প্রথম সক্রিয় হলো, এমন নয়। দেশটির ঢাকার দূতাবাসের একটি সৌদি-বাংলাদেশি চক্র প্রতি ভিসার জন্য ২২০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছে এ বছরের শুরু থেকে কয়েক মাস ধরে। এমন অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আজকের পত্রিকাকে গত জুলাইয়ে বলেছিলেন, কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে। এ নিয়ে বেশ হইচই এবং সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ডলারে ঘুষ নেওয়া বন্ধ হয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সেই কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব বড় শ্রমবাজার বলে দেশটি নিয়ে বেশ স্পর্শকাতরতা রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার পরিণামে দুই বছর শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। সৌদি শ্রমবাজার নিয়ে যাতে এ ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে সরকার সতর্ক রয়েছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাবে, চলতি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ৮ লাখ ৭৪ হাজারের বেশি শ্রমিক গেছেন। তাঁদের মধ্যে ৫ লাখ ১৩ হাজারের বেশি (৫৮ শতাংশ) গেছেন সৌদি আরবে। বায়রার কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত তিন লাখ কর্মীর পাসপোর্টে গড়ে ২০০ ডলার করে নেওয়া হলেও চক্রগুলো অন্তত ছয় কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।

সৌদি আরবে লোক পাঠানোর জন্য প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে থাকে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ টাকা। সৌদি দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রায় ছয় লাখ সৌদি ভিসা ইস্যু হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ছিল কর্মী ভিসা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত