Ajker Patrika

মা জানতেন, কালা জাহাঙ্গীর মারা গেছে

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ৩১
Thumbnail image

খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাব, হঠাৎ বেল বাজল। একবার-দুবার নয়, বেজেই চলেছে। মেয়েকে বললাম, দেখ তো মা, এত রাতে কে এল? মেয়ে বলল, মনে হয় পুলিশ। 
কটা হবে তখন?

রাত ১১-১২টা বা তার বেশি। আমরা এই সময়ে ঘুমোতে যাই।

তারপর?

মেয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে চার-পাঁচজন ঘরে ঢুকে পড়ল। আমার বাড়িতে প্রায়ই পুলিশ আসে। মনে করলাম, এবারও এল। সবাই সাদা পোশাকে। কারও হাতে কোনো অস্ত্র নেই।  

কী পরিচয় দিল?

সবাই নিজেদের পুলিশ বলেই পরিচয় দিল। তল্লাশি-টল্লাশি না করে বলল, আমাদের সঙ্গে চলেন।

প্রশ্ন করলেন না, কোথায় যাবেন?

করলাম, তারা বলল কোনো কথা হবে না। যা বলছি শোনেন, যেতে হবে। যে কাপড়ে ছিলাম বের হলাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি গলির মোড়ে একটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে, তাতে আরও কয়েকজন বসে। আমাকে সেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে থাকল। কিছুক্ষণ পর গাড়িটা থামল একটা উঁচু ভবনের পেছনে। দেখি একটু দূরে আরেকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। বলল, ওই গাড়িতে গিয়ে বসেন। সেটা ছিল প্রাইভেট কার। গাড়ির সামনে একজন বসা। পেছনের সিট খালি। আমি গিয়ে সেই গাড়িতে বসতেই গাড়িটা চলতে শুরু করল, পেছনে সেই মাইক্রোবাস। দুটি গাড়ি এসে থামল একটি বস্তির সামনে। আমাকে বলল বস্তির ভেতরে যেতে হবে।

গেলেন? আপনার ভয় করেনি?

এতক্ষণ কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এত রাতে অন্ধকার বস্তি দেখে খুব ভয় হলো। কি-না-কি হয় বুঝতে পারছি না। কিন্তু যুবকেরা আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করছে। তারা আমাকে বস্তির একটি ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে চাদর দিয়ে একটি মৃতদেহ ঢাকা। একজন চাদর তুলে বলল, দেখেন তো চিনতে পারেন কি না? মুখটা দেখেই চিনলাম। আরও নিশ্চিত হতে বললাম, ডান হাতটা দেখান। তারা ডান হাত দেখাল।

ডান হাতে কী ছিল?  

ডান হাতের ওপরে একটি নীলাভ জন্মদাগ ছিল। সেটা দেখেই বুঝলাম এটা আমার ছেলের লাশ। আমি ডুকরে কেঁদে উঠে বললাম, এটা আমার ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর। লাশ শনাক্তের পর ওরা আমাকে আর দাঁড়াতে দিল না। আবার সেই গাড়িতে তুলে বাড়ির গেটে নামিয়ে দিয়ে গেল। আর বলে গেল, সবাই আমার ছেলের দলের লোক। এ নিয়ে আমি যেন কোনো বাড়াবাড়ি না করি, থানা-পুলিশ না করি।

এ ঘটনা কবেকার?  

২০০৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর, সেদিন সোমবার ছিল। এরপর আমি কিছু জানি না, শুনেছি লাশ সেখানেই দাফন করা হয়েছে।

কীভাবে আপনার ছেলে মারা গেল, কিছু জানতে পেরেছিলেন?

পেয়ারা বেগম বললেন, জাহাঙ্গীরের সবকিছু দেখভাল করত তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিটেল। তাকে বলত দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। সে একদিন রাতে এসে বলল, র‍্যাবের ধাওয়া খেয়ে মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। জাহাঙ্গীরের বউ সোনিয়া তখন গর্ভবতী। সেই অবস্থায় টেলিফোনে সোনিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয় জাহাঙ্গীরের। জাহাঙ্গীর খুব উত্তেজিত ছিল। ঝগড়াঝাঁটির একপর্যায়ে নিজের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ফোনের অন্য প্রান্তে তখন সোনিয়া ছিল। তাকে কোনো হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। সেই বাড়িতেই মরে পড়ে ছিল। রাতে দলের লোকেরা তাকে দাফন করতে বস্তিতে নিয়ে যায়। 

সোনিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছিল সেদিন?

জানব কী করে? কিছুদিন পর মিরপুরে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিটেল মারা যায়। তার কয়েক দিন পর সোনিয়া আক্তারকে ডিবির এসি আখতারুজ্জামান রুনু ধরে নিয়ে যায়। সোনিয়া জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। জাহাঙ্গীরের একটি ছেলে আছে, সেই নাতির জন্য খুব মন খারাপ হয়। বলতে বলতে চোখ মুছলেন তিনি।

যে নারীর সঙ্গে আমার এই দীর্ঘ কথোপকথন, তাঁর নাম পেয়ারা বেগম। ষাট ছুঁইছুঁই এই নারী মিরপুরের সেনাপল্লী স্কুলের শিক্ষক। যে মৃতদেহের বর্ণনা তিনি দিচ্ছিলেন, সেটা তাঁরই সন্তান রাজধানী কাঁপানো শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর।

পেয়ারা বেগমের সঙ্গে আমার এই কথোপকথন ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারিতে, তাঁর ইব্রাহিমপুরের বাড়িতে বসে। পেয়ারা বেগম সন্ত্রাসী সন্তানের মৃত্যুর কথা অনেক দিন চেপে রেখেছিলেন। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি র‍্যাবের কাছে প্রথম এ ঘটনা স্বীকার করেন।

র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক প্রয়াত আনোয়ার ইকবাল আমাকে ডেকে নিয়ে সেই ঘটনা জানিয়েছিলেন। এবার সেই গল্পটা বলি।

ওয়ান-ইলেভেন সময়ের পরিচিত নাম ব্রিগেডিয়ার চৌধুরী ফজলুল বারী। তিনি তখন র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। আনোয়ারুল ইকবাল আমাকে বললেন, কয়েক দিন আগে বারীর কাছে এসেছিলেন ওই সময়ের পুরস্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের মা পেয়ারা বেগম, তাঁর ভাই ক্যাপ্টেন (অব.) আলমগীর ফেরদৌস ও আলমগীরের স্ত্রী। তাঁরা দাবি করেছেন, কালা জাহাঙ্গীর মারা গেছেন। মা নিজে সন্তানের লাশও দেখেছেন। তিনি আমাকে বললেন, র‍্যাব বিষয়টি পুরোপুরি আস্থায় নেয়নি। এটা কালা জাহাঙ্গীরকে আড়াল করার কৌশলও হতে পারে। আমি যেন ঘটনাটা যাচাই করে দেখি। আমি এরপর ফজলুল বারীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কালা জাহাঙ্গীরের মায়ের খোঁজে নেমে পড়ি।

পেয়ারা বেগম তখনো সেনাপল্লী স্কুলের শিক্ষক। আমি যখন স্কুলে এলাম, তখন টিফিনের বিরতি চলছে। প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে পেয়ারা বেগমের নাম বলতে তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে জানতে চাইলেন–আমি পুলিশ না গোয়েন্দা। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই বসতে বললেন। এরপর ডেকে দিলেন পেয়ারা বেগমকে।
পেয়ারা বেগম খুবই স্বাভাবিক, যা বলি তারই উত্তর দেন। কথায় কথায় তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁদের ইব্রাহিমপুরের বাড়িতে। তিনি রিকশায় আর আমি পেছনে মোটরসাইকেলে। একটি চারতলা বাড়ির দোতলায় নিয়ে তুললেন। বেল বাজাতে এক তরুণী এসে গেট খুলে দিল। তাঁকে দেখিয়ে বললেন, আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ও রুমা, সবার ছোট। রুমা সালাম দিয়ে সরে গেলেন। একটু পরে তিনি আরেক ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এসে জানান, তিনি জাহাঙ্গীরের বড় ভাই ক্যাপ্টেন আলমগীর ফেরদৌস। ক্যাপ্টেন আলমগীর তখন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়ে কাঠের ব্যবসা করছেন। মা-ছেলে মিলে পুরো ঘটনার বিবরণ দিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে পরিবারটি বেঁচে গেছে। পেয়ারা বেগম বললেন, মিথ্যে অভিযোগে তাঁর বড় ছেলের চাকরি গেছে। সে নাকি জাহাঙ্গীরের জানাজায় অংশ নিয়েছিল।

শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিয়ে তখন নানা গুজব। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল, কালা জাহাঙ্গীরকে আড়াল করার জন্য এসব রটানো হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন তিনি বিদেশে চলে গেছেন। ওই সময় কালা জাহাঙ্গীরের মাথায় এক ডজন খুনের মামলা আর গোটা বিশেক জিডি। পুরান ঢাকার শহীদ কমিশনারের আশ্রয়ে থেকে তখন একের পর এক খুন করে যাচ্ছিলেন। সে সময় পোস্তগোলার কমিশনার শাহাদত ছিলেন শহীদ কমিশনারের প্রতিপক্ষ।

কালা জাহাঙ্গীরের হাত থেকে বাঁচতে তিনি আসিফ নামে আরেক সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি। আদালত চত্বরে মুরগি মিলনকে খুন করার পর উত্তরার রাস্তায় গাড়ির ভেতরে গুলি করে শাহাদতকে খুন করেন কালা জাহাঙ্গীর। কারওয়ান বাজারের সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ। ইব্রাহিমপুরে বেড়ে ওঠা কালা জাহাঙ্গীরকে পুলিশ কখনো ধরতে পারেনি। ছোটবেলার একটি মাত্র ছবি ছাড়া পুলিশের কাছে তাঁর কোনো ছবি ছিল না। সাধারণ কোনো মানুষও তাঁকে চিনত না। তাঁর সব কর্মকাণ্ড ছিল অ্যাকশন সিনেমার গল্পের মতো ভয়ংকর।  

কালা জাহাঙ্গীরের বাড়ি থেকে বের হয়ে ফোন দিলাম ঢাকা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি ফররুখ আহমেদকে। সিআইডিতে থাকার সুবাদে কালা জাহাঙ্গীরের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতেন। ফররুখ আহমেদ বললেন, তাঁর একাধিক সোর্স জানিয়েছে, কেরানীগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গা ব্রিজের আশপাশে প্রতিপক্ষের গুলিতে কালা জাহাঙ্গীর আহত হয়েছিলেন। দলের লোকজন তাঁর চিকিৎসার জন্য গুলশানের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। পুলিশ সে খবর পেয়ে ক্লিনিকে অভিযান চালায়। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁকে সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পায়নি সিআইডি।

কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিয়ে আমি একটি নিউজ করি (৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, প্রথম আলো)। এরপর শুরু হয় বিতর্ক। পেয়ারা বেগমের বক্তব্য ধরে মিসরের ফারাও রাজা ‘তুতানখামেন’-এর কবর আবিষ্কারের মতো করে কালা জাহাঙ্গীরের কবর খুঁজতে নেমে পড়ি আমরা। আমার সঙ্গে বিডিনিউজের সাংবাদিক লিটন হায়দার। আমাদের ভাগ্য ভালো, তুতানখামেনের মতো সেই কবরে কোনো অভিশাপ ছিল না। সে কারণে সহজে পেয়ে যাই। একদিন আমি আর লিটন হায়দার যাই মহাখালীর সাততলা বস্তির পেছনে। সেখানকার লোকেরা আমাদের জানান, একদিন গভীর রাতে জনাবিশেক অস্ত্রধারী যুবক এসে একটি লাশ দাফন করে চলে যায়। তাদের অস্ত্র দেখে ভয় পেয়ে যান তাঁরা। সে কারণে তাঁরা কাউকে বিষয়টি বলেননি। কালা জাহাঙ্গীরের মায়ের বর্ণনার সঙ্গে তাঁদের বিবরণ মিলে যায়।

এরপর থেমে যায় কালা জাহাঙ্গীরের নামে সব ধরনের তৎপরতা। কালা জাহাঙ্গীরকে ধরতে ওই সময় সরকার এক লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তখন তাঁকে ধরেনি। ইব্রাহিমপুরের মশিউর রহমান কচির ভাই আজাদকে খুনের পর কালা জাহাঙ্গীর নিজে জনকণ্ঠ অফিসে ফোন করে সেই খুনের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, পুলিশ আমাকে ধরলে পাবে পুরস্কারের এক লাখ টাকা, আর না ধরলে প্রতি মাসে পাবে সেই টাকা–তাহলে ধরবে কেন? সত্যিই, শেষ পর্যন্ত অধরা থেকে গিয়েছিলেন ভয়ংকর খুনি কালা জাহাঙ্গীর।

আরও পড়ুন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত