Ajker Patrika

সন্ত্রাসী বিকাশের বন্ধুরা

কামরুল হাসান
সন্ত্রাসী বিকাশের বন্ধুরা

২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর, শুক্রবারের সকালটা ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা। একটু দূরের কোনো কিছু দেখা যাচ্ছিল না। হাইওয়ের গাড়িগুলো চলছিল কুয়াশা বাতি জ্বালিয়ে, ধীরগতিতে। সে রকম কচ্ছপগতিতে তিনটি গাড়ি এসে থামল কাশিমপুর-২ কারাগারের সামনে। ছুটির দিনে কারাগারের সামনে লোকজনের ভিড় নেই। তবু গাড়ির আরোহীরা কেউই নামলেন না, ঠায় বসে থাকলেন গাড়ির ভেতরে। ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর একজন এসে ইশারা করতেই সবাই নড়েচড়ে বসলেন। ততক্ষণে সকাল আটটা বেজে কুড়ি মিনিট।

একটু পরে কারাগারের নিরাপত্তায় বসানো সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। খুলে গেল কারাগারের মূল ফটক। এরপর মাঝারি উচ্চতার একহারা গড়নের এক ব্যক্তি মাথা নিচু করে ফটক থেকে বেরিয়ে বাইরে এলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন, সোজা গিয়ে উঠলেন মাঝখানের গাড়িটিতে।

কারও মুখে কোনো কথা নেই, গাড়িগুলো কারাগার চত্বর থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠে গেল। ততক্ষণে কুয়াশা কমতে শুরু করেছে, গাড়িগুলোও গতি পেয়ে গেল।

যাঁর জন্য এই মহা আয়োজন, তিনি শীর্ষস্থানীয় কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস ওরফে বিকাশ। সহোদরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে যাঁদের একমাত্র পরিচয় ‘বিকাশ-প্রকাশ’ গ্রুপ।

ঢাকায় যখন ক্রাইম রিপোর্টিং শুরু করি, তখন রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে সহোদর সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল দুটি। এর একটি হলো হারিস-জোসেফ, অন্যটি বিকাশ-প্রকাশ। তবে হারিস-জোসেফের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য হলো, হারিস-জোসেফদের যোগাযোগ ছিল সমাজের উঁচু স্তরে; সেই তুলনায় বিকাশ-প্রকাশের চলাচল নিচুতলায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা কাজ করতেন ভাড়াটে হিসেবে। যে কারণে এলাকার এক এমপি ছাড়া আর কারও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা তাঁরা পাননি। সর্বশেষ বিকাশকে জেল থেকে বেরোতেও ‘সুপারি’ থেকে পাওয়া কোটি কোটি টাকা ঢালতে হয়েছে। তবে সে কথায় পরে আসছি, তার আগে দুই ভাইয়ের ঠিকুজিটা একটু ঝালাই করে নেওয়া যাক।

দুই ভাইয়ের পিতার নাম বিমল চন্দ্র বিশ্বাস। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার শিবনগরে। প্রকাশ বড়, বিকাশ ছোট। তাঁদের আরও দুই ভাই আছে—রনি ও প্রতাপ। রনি কয়েক বছর আগে মাদকাসক্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতাপ এখন কালীগঞ্জ বাজারে ওষুধের ব্যবসা করে। আর আছেন বৃদ্ধ মা। ৮০ বছরের এই নারী গ্রামের বাড়িতে একাই থাকেন।

বিমল চন্দ্র বিশ্বাসের জীবন শুরু হয়েছিল ঢাকায়, ছোটখাটো চাকরি দিয়ে। চার ছেলেকে নিয়ে ভালোই চলছিল। থাকতেন মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায়। বড় ছেলে বিকাশ কলেজে উঠেই বেপরোয়া হয়ে পড়েন। শুরু হয় পাইকপাড়াকেন্দ্রিক মাস্তানি। সঙ্গে আরও কিছু তরুণ জুটে যায়। এরপর পায় কে। ১৯৮৫ সালের দিকে এশিয়া সিনেমা হলের টিকিট বিক্রি নিয়ে হলের কালোবাজারি রমজানের সঙ্গে বিরোধ বাধে। একদিন রমজানকে খুন করে ফেলেন। রমজান খুন হওয়ার পর প্রকাশের ‘নামডাক’ হয়ে যায়। ছোট ভাই বিকাশ তখন পড়তেন মিরপুর বাঙলা কলেজে। দাদার (কু) খ্যাতি তাঁকেও স্পর্শ করে। দেখা যায়, পথঘাটে লোকজন প্রকাশের ভাই হওয়ার কারণে তাঁকে বেশ খাতির-যত্ন করে। এই লোভ আর ছাড়তে পারেন না বিকাশ। তিনিও ভাইয়ের পথ ধরেন। একপর্যায়ে প্রকাশ-বিকাশ বাহিনী হিসেবে তাঁদের নাম চলে আসে পুলিশের খাতায়।

আগারগাঁও এলাকায় সে সময় জমজমাট ঠিকাদারি ব্যবসা। ই-টেন্ডার তখনো শুরু হয়নি। ভয় দেখিয়ে বা টেন্ডার বাক্স দখল করা ছিল প্রাচীন আমলের রাজ্য দখল করার মতো। কিছু ঠিকাদার সেই সুযোগ কাজে লাগাতেন। একদল ঠিকাদার টেন্ডার দখল করতে প্রকাশ ও বিকাশকে ভাড়ায় নিয়ে আসেন। এভাবে আগারগাঁও পিডব্লিউডির দপ্তর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ সময় বাধা হয়ে দাঁড়ান প্রতিপক্ষ ঠিকাদারের ভাড়াটে আরেক সন্ত্রাসী শামীম। একদিন পিডব্লিউডি দপ্তরের ভেতরেই শামীমকে গুলি করে হত্যা করেন দুই ভাই। সঙ্গে শামীমের সহযোগী মামুনও খুন হয়। এই খুনের পর রাতারাতি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের হিরো বনে যান দুই ভাই। বিকাশ-প্রকাশের নাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। তাঁদের ঠিকাদারি কাজে ছাত্রলীগ নেতা জরিপ বাধা হয়ে দাঁড়ান। এরপর তাঁরা জরিপকেও খুন করেন। একে একে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত আলী মিস্টার, গুদারাঘাটের টিপু, কল্যাণপুরে মুদিদোকানি রুহুল আমিন, মিরপুরে খাজা মার্কেটের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন, শিল্পপতি আজহারুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ, ভিডিও সেন্টারের মালিক মাহবুবসহ অনেকে খুন হন তাঁদের হাতে। তখন দেখা যেত, প্রতি মাসেই কেউ না কেউ তাঁদের হাতে খুন হচ্ছে।

প্রকাশ-বিকাশ এরপর মিরপুর-আগারগাঁও এলাকা থেকে বাসাবোতে আস্তানা গাড়েন। ঢাকায় তখন সুইডেন আসলাম, হারেস, জোসেফ, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, টিক্কা, মুরগি মিলন ও লিয়াকত হোসেনের দাপট চরমে। আধিপত্য নিয়ে শুরু হয় সংঘাত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় লিয়াকত ও মুরগি মিলন এগিয়ে যান। পিছিয়ে পড়েন প্রকাশ-বিকাশ।

১৯৯৭ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা তৈরি করে। সেই তালিকায় প্রথম দুই ভাইয়ের নাম আসে। এই তালিকা প্রকাশের পর ১৯৯৭ সালে মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন নারায়ণগঞ্জ থেকে বিকাশকে গ্রেপ্তার করেন। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি খুনের মামলা ছিল। সেই থেকে জেলেই ছিলেন বিকাশ। আর প্রকাশ তখনো বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর ছবি, পরিচয়সহ তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা বেরোলে প্রকাশ পালিয়ে ভারতে চলে যান। সেখান থেকে ফ্রান্সে। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন। তবে ফ্রান্সে থাকলেও তাঁর নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে ঢাকায়। এরপর ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। এতেও তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়। জেলে থাকলেও বিকাশ কখনো থেমে থাকেননি। কারাগারে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছিলেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাঁর লোকেরা সক্রিয় ছিল। সর্বশেষে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার কয়েক দিন আগে দেশ ছাড়েন। পুলিশের মতে, সেই মুসাও ছিলেন প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের সদস্য।

বিকাশের সেই গোপন মুক্তির খবর আমরা জেনেছিলাম অনেক পরে, ওই দিন বিকেলের দিকে। ততক্ষণে তিনি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে। শুনেছি, বেনাপোল সীমান্ত হয়ে প্রথমে যান ভারতের হরিদাসপুরে, তারপর কলকাতায়। সম্ভবত এখন তিনি ফ্রান্সে আছেন। তখন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, বিকাশের এই মুক্তির পেছনে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছিল। কারা সেই টাকার ভাগ পেয়েছিলেন, সেটা পুরো গল্পটি পড়লেই আঁচ করা যাবে। তবে প্রমাণ ছাড়া তো কাউকে অভিযুক্ত করা যায় না।

যেমন, বিকাশকে মুক্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় খুব গোপনে, যাতে কাকপক্ষীও টের না পায়। সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধের কথা তো আগেই বলেছি। এমনিতে কারাগারের নিয়ম অনুসারে সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্তের আগের সময় ছাড়া অন্য সময়ে কোনো বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয় না। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে বিকাশকে মুক্তি দেওয়া হয় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। আবার শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেলে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হয়।

তখন গাজীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন আবদুল বাতেন। তিনি এখন ডিআইজি। আমি ঘটনার দিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের নলেজে নেই।’ গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো সারা দিন মানিকগঞ্জে ভাই’। গাজীপুর সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন কানিজ জাহান। তিনি বলেছিলেন, ‘তাই নাকি? জানি না তো ভাই।’

এবার আসি কারাগারের কথায়। কাশিমপুর কারাগার-২-এর কারাধ্যক্ষ ছিলেন সুভাষ চন্দ্র ঘোষ। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘নিয়ম মেনেই আমরা তাঁকে মুক্তি দিয়েছি।’ আর কারা মহাপরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম খান বলেছিলেন, ‘আমাকে কেন বলছেন ভাই, আপনাদের মন্ত্রীর কাছে জানতে চান।’

ফোন দিয়েছিলাম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। তিনি বলেছিলেন, ‘একটা লোক ১৫ বছর জেলে ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে নতুন আর কী অভিযোগ আসতে পারে? জেলের ভেতরে থেকে সে কী অপরাধ করবে? তুমি বললেই তো হবে না।’

মন্ত্রীর এই কথার পর আর কিছু কি বলার আছে? আশা করি পাঠকের কাছে সব খোলাসা হয়ে গেছে। আরেকটু বলে রাখি, ওই দিন গাজীপুর জেলা পুলিশের দুজন কর্মকর্তা বিকাশের মুক্তির সময় কারাগারের আশপাশেই ছিলেন। অন্য কোনো সংস্থা যাতে বিকাশকে কারা ফটক থেকে ধরে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন তাঁরা।

আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’ লেখা শেষ করার আগে প্রকাশ-বিকাশের পরিবারের খোঁজ নিতে আজকের পত্রিকার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি মো. আবদুর রহিম গিয়েছিলেন শিবনগর গ্রামে। তিনি খোঁজ নিয়ে বললেন, মহাপ্রতাপশালী এই সন্ত্রাসীদের পরিবার গ্রামে একেবারে বিচ্ছিন্ন। তাদের সঙ্গে কেউ মেলামেশা করে না, আত্মীয়তাও করে না। তাদের আত্মীয়স্বজনও নিজেদের পরিচয় দেন না। বিকাশ-প্রকাশের এক খালাতো ভাই তাঁকে বলেছেন, ‘ওরা সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী কারও স্বজন হতে পারে না, আমারও না। তারা আমাদের কেউ না।’

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত