Ajker Patrika

ভেস্তে যাওয়া এক ‘আষাঢ়ে গল্প’

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১৭
Thumbnail image

বন্ধুমহলে আরিফ রহমানের নাম ছিল ‘মটু আরিফ’। যেমন দেহ তেমন খায়, উচ্চতাও সেই রকম। কথায় কথায় নিজেকে বলত ‘বোগরার ছৈল’ (বগুড়ার ছেলে)। যেন বগুড়া বাড়ি হওয়া বিরাট কিছু। খাওয়ার শেষপাতে বাচ্চাদের মুখে যেভাবে দুধভাত লেগে থাকে, আরিফের মুখেও সেভাবে লেপটে থাকত বগুড়ার আঞ্চলিক উচ্চারণ। ৯০-এর পর ঢাকায় থানা গাড়তে এসেছিল বগুড়ার দৈনিক করতোয়ার সাংবাদিক হিসেবে। তারপর আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ থেকে চলে গেল আজকের কাগজে, ক্রাইম রিপোর্টার হয়ে। একদিন দুপুরে আরিফের ফোন।

বন্ধু, ‘হামাক একটা কাম করে দিবু। না করবু ন্যা কিন্তু। এক ছৈল খুব বিপদে পড়ছে। তুই না হলে হবি ন্যা।’

আরিফ এভাবেই বলে। আমি বললাম, আগে বল কী হয়েছে।

আরিফ যা বলল, তা আমাকে একটু চিন্তায় ফেলে দিল। এটিএন বাংলার প্ল্যানিং এডিটর কেরামত উল্লাহ বিপ্লব তখন বাংলাবাজার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। কসকো সাবানের উৎপাদনকারী কমান্ডার সোপ কোম্পানি ছিল পত্রিকাটির মালিক। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অফিস। সেখান থেকে রিকশায় করে বেশ রাতে মগবাজারের বাসায় ফিরছিলেন বিপ্লব। তাঁর রিকশাটি মগবাজার মসজিদের সামনে এলে একদল ছিনতাইকারী গতিরোধ করে। তারা বিপ্লবকে মেরেধরে তাঁর মোবাইল ফোনসহ সবকিছু কেড়ে নেয়। ছিনতাইকারীদের হাতে সবকিছু খোয়ালেও বিপ্লবের আফসোস ছিল শখের মোবাইল ফোনটি নিয়ে। যে করেই হোক ফোনটা উদ্ধার করে দিতে হবে। আরিফের পীড়াপীড়িতে বললাম, দেখি কাউকে অনুরোধ করে উদ্ধার করা যায় কি না। তখন সবার হাতে হাতে যেমন মোবাইল ফোন ছিল না, তেমনি মোবাইল ফোনের কলরেকর্ড, কললিস্ট বা অবস্থান জানার ব্যবস্থাও ছিল না। ফোন একবার হারালে মহাবিপদ।

বিপ্লবের সেই ফোন উদ্ধারের জন্য প্রথম কল দিলাম রমনা থানার তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলামকে। দেখি এ ঘটনা তিনি আমার আগেই শুনেছেন। বললেন, এই ফোন উদ্ধার করা তাঁর পক্ষে একেবারে অসম্ভব। তবে একটা পথ বাতলে দিলেন। বললেন, কারওয়ান বাজার থেকে মগবাজার রেলগেট পর্যন্ত এলাকায় যেসব চাঁদাবাজি-ছিনতাই হয়, সবই করে পিচ্চি হান্নানের ছেলেরা। আর রেলগেটের দক্ষিণ দিকের নিয়ন্ত্রণ আরমানের হাতে। আরমান যুবলীগের নেতা লিয়াকত হোসেনের ঘনিষ্ঠ। লিয়াকতকে বললে কাজ হতে পারে।

নিউ ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনের উলটো দিকে মোটর পার্টসের মার্কেট হেলেনা সেন্টারে যুবলীগের নেতা লিয়াকতের আস্তানা। সেই আস্তানায় টিঅ্যান্ডটির একটি ফোন ছিল। ফোন দিলাম সেই নম্বরে। লিয়াকত নিজেই ফোন ধরে সব শুনে বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করেন, দেখি কী করা যায়।’ বিকেলের দিকে জনকণ্ঠের পিএবিএক্স নম্বরে ফোন দিলেন আরমান নিজেই। বললেন, ছিনতাইকারীদের তিনি শনাক্ত করেছেন, ফোনও পাওয়া গেছে। যাঁর ফোন তাঁকে এসে নিয়ে যেতে হবে। ছিনতাই হওয়ার পর বিপ্লব খুব ভয় পেয়ে গেছেন। ফোন আর নিতে আসেন না। পরে আরিফসহ এসে ফোনটা লিয়াকতের অফিস থেকে বুঝে নেন বিপ্লব।

এ গল্পের শেষের দিকে যে আরমানের কথা বললাম, সেই আরমানই ছিল সরকারের পুরস্কার ঘোষিত ১২ নম্বর শীর্ষ সন্ত্রাসী। তবে আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’–এ শুধু সন্ত্রাসী আরমানের গল্প বলব না। বলব এই সন্ত্রাসীকে সঙ্গে নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের গল্প। যে ষড়যন্ত্র শুধু গণমাধ্যমের চাপে খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আপনাদের নিশ্চয় সেই মামলার জজ মিয়ার কথা মনে আছে? এই জজ মিয়া গল্পের প্লট সাজাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমানকেও আনা হয়েছিল। জজ মিয়াকে দিয়ে যেভাবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়, সেভাবে আরমানের জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখির পর সব ভেস্তে যায়। ‘জজ মিয়াকে নিয়ে পুলিশের আষাঢ়ে গল্প’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি রিপোর্ট তখন বেশ হইচই ফেলেছিল। তবে ষড়যন্ত্র নিয়ে বলার আগে আরমানের কীর্তিকলাপগুলো একটু বলি।

আরমানের বাবার নাম এস এম আইনুল হক। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে আরমান সবার বড়। বড় মগবাজার এলাকায় বছরের পর বছর ধরে তাঁদের পরিবারের বসবাস। আরমান দেখতে যেমন স্মার্ট, কথাবার্তায় তেমনি বিনয়ী। খুব নিচু স্বরে কথা বলতেন। কথা বলার সময় কারও চোখের দিকে তাকাতেন না। তাঁর পোশাক-আশাক ছিল চোখধাঁধানো। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তাতে আরমানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার টাকা। ওই সময় তাঁর ছবিসহ পোস্টার সারা দেশে সাঁটানো হয়। তখন আরমানের বিরুদ্ধে হত্যাসহ মামলা ছিল ১৩টি।

এবার বলি, আরমান কী করে এত বড় সন্ত্রাসী হলেন। আপনাদের নিশ্চয় সেই ‘সেভেন স্টার’ নামকরণের গল্পটা মনে আছে। কথিত সেই সেভেন স্টার বাহিনীর প্রধান ছিলেন ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। মগবাজার ও এর আশপাশের এলাকা ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মোল্লা মাসুদ আর টিক্কা। মগবাজারের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোখলেছুর রহমান ছিলেন টিক্কার আপন মামা। স্বাভাবিকভাবেই টিক্কা মগবাজার এলাকায় খুব প্রভাবশালী ছিলেন।

সেভেন স্টারের সেই সুব্রত বাইনের হাত ধরেই সন্ত্রাসী জগতে আসেন আরমান। সুদর্শন আরমান তখন চাঁদাবাজি করতেন। কিছুদিনের মধ্যে মোল্লা মাসুদ ও টিক্কার সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। সুব্রত বাইনের সঙ্গ ত্যাগ করে যোগ দেন লিয়াকতের দলে। খুব অল্প দিনেই তিনি মুরগি মিলন ও লিয়াকতের ডানহাতে পরিণত হন। সে সময় মুরগি মিলনের সঙ্গে তাঁর দারুণ ভাব জমে যায়। দুজন একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। মিলনের হয়ে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের কাজ নেন আরমান।

এভাবে বেশ কয়েক বছর পার হয়। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর অবস্থা বুঝে লিয়াকত ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। আরমান তখন কারওয়ান বাজারের সন্ত্রাসী পিচ্ছি হান্নানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সেখানেও এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। সম্পর্কটাও ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত লিয়াকতের সঙ্গে ভারতে পাড়ি জমান। সেখানে কিছুদিন কলকাতার একটি হোটেলে ছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতা পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। তবে কিছুদিন পরেই তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এরপর লিয়াকত দেশে ফিরে এলেও আরমান ভারতেই থেকে যান। 

ফিরে আসেন ২০০৫ সালের মে মাসের দিকে। ঢাকায় ফিরে কেরানীগঞ্জে তাঁর বোনের বাড়ির পাশে একটি বাড়িভাড়া নিয়ে আত্মগোপন করেন। ওই বছরের ৩ জুন রাতে ধানমন্ডির একটি বাড়ি থেকে র‍্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আরমানকে গ্রেপ্তারের পর শুরু হয় সেই ষড়যন্ত্রের খেলা।  

আরমানকে গ্রেপ্তারের সাত-আট দিন পর, ২০০৫ সালের ১০ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি পুলিশ। তাঁকে কয়েক দফা রিমান্ডে এনে অনেক মারধর করা হয়। আরমানকে গ্রেপ্তারের পরের দিন (১১ জুন) মগবাজারের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মোখলেছুর রহমান ও আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর আরমান, জজ মিয়া এবং মোখলেছকে নিয়ে একটি গল্প ছেড়ে দেওয়া হয় বাজারে। সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, মোখলেছুর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। মোখলেছুর রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। আর বলা হয়, শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান নোয়াখালীর জজ মিয়াকে আগে থেকেই চেনেন। গ্রেনেড হামলার পর তাঁরা একসঙ্গে ভিনদেশে অবস্থান করেছিলেন। (প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০০৫)

র‍্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল চৌধুরী ফজলুল বারী এই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, র‍্যাব আরমানের কাছ থেকে ২১ আগস্ট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে (প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০০৫)। আরমানকে জেরা করার পর তখন র‍্যাব জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ত্রিমাতি সুব্রত বাইন, মুকুল এবং জয়। হামলার জন্য তাঁরা একটি বিশেষ সংস্থার সঙ্গে আড়াই কোটি টাকার চুক্তি করেছিলেন। চুক্তির ৫০ লাখ টাকা নাকি আগাম দেওয়া হয়েছিল। তখন নিজেদের তদন্ত বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ করতে ইন্টারপোলকেও ডেকে এনেছিল সিআইডি।

তখন অবশ্য আরেকটি কথা বাজারে চালু ছিল। ঠিক একই সময়ে এরশাদের মামলায় তাঁর স্ত্রী বিদিশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিদিশার ওপর সরকারি জুলুম-নির্যাতন নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনাও হয়। শোনা যায়, সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে আরমানকে সামনে আনা হয়।

এরপর সিআইডি জজ মিয়ার কাছ থেকে গ্রেনেড হামলা নিয়ে একটি সাজানো স্বীকারোক্তি আদায় করে। আরমানের কাছ থেকেও স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তখন যেভাবেই হোক জজ মিয়ার একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গণমাধ্যমে চলে আসে। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে জজ মিয়ার পরিবারকে খরচ দিচ্ছে সিআইডি। তাঁকে দিয়ে যা বলানো হচ্ছে সবই সাজানো। চারদিকে ছি ছি পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আরমানকে দিয়ে সাজানো জবানবন্দি দেওয়ানোর চেষ্টা থেকে সরে আসে ষড়যন্ত্রকারীরা। একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে নাটক সাজানোর চেষ্টা এভাবেই থেমে যায়। সেই থেকে গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি সেলে দিন কাটাচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান।  

আরও পড়ুন

বিষয়:

আষাঢ়ে-নয়
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত