Ajker Patrika

অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১২
অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা

পোস্তগোলা এলাকার ভূস্বামী ছিলেন মনু মিয়া। মূল সড়কের পাশে তাঁর বিশাল বাড়ি। লোকে বলত মনু জমিদারের বাড়ি। মনু মিয়ার ছয় ছেলে। তাঁদের বউয়েরা এবং ছেলে-মেয়েরা থাকেন এ বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার পথ অনেকটা দুর্গের ফটকের মতো।

একদিন গভীর রাতে সেই বাড়িতে শুরু হলো গোলাগুলি। একটি-দুটি নয়, শত শত, হাজার হাজার। বৃষ্টির মতো গুলির শব্দে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলল।

এত গোলাগুলির শব্দে এলাকার মানুষের ঘুম উবে গেল। স্বাভাবিকভাবে ক্রাইম রিপোর্টারদের মোবাইল ফোনও গরম হয়ে উঠল। কী হচ্ছে তা বুঝে উঠতে উঠতে ভোর হয়ে গেল।

মোটরবাইক নিয়ে ছুটলাম পোস্তগোলার দিকে। স্বামীবাগ-দয়াগঞ্জ বিশাল সড়কটি তখনো হয়নি। পোস্তগোলায় যেতে হতো লক্ষ্মীবাজার হয়ে অথবা সায়েদাবাদ পার হয়ে পোস্তগোলা ব্রিজ বাঁ হাতে রেখে।

২০০০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বুধবারের ভোর। যখন পৌঁছালাম, লোকজন তখন ফজরের নামাজ শেষে বের হয়েছেন। মনু জমিদারের বাড়ির সামনে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ছে। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখি গোটা দশেক পুলিশের গাড়ি, সবই গোয়েন্দা পুলিশের। ‘ডিবি’ লেখা জ্যাকেটের প্রচলন তখনো শুরু হয়নি, ডিবির পুলিশ সদস্যরা সাদাপোশাকে অপারেশনে যেতেন। সেখানে দেখি অনেকে আবার বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পরে আছেন। এটা কোন টিম? প্রশ্ন করতেই মুখচেনা এক পুলিশ সদস্য বললেন, এসি তানভীর স্যারের। দূরে দাঁড়িয়ে ডিবির তৎকালীন এসি তানভীর হায়দার চৌধুরী (বর্তমানে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি) নির্দেশনা দিচ্ছেন। তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কী হয়েছে। তিনি বললেন, যা বলার, ডিসি স্যার বলবেন। ডিবিতে তখন একজনই ডিসি–মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচের মুহাম্মদ আবদুল হান্নান।

ঘটনাস্থলের একটু দূরে দেখি, রাস্তার এক পাশে ওয়াকিটকি হাতে দাঁড়িয়ে শ্যামপুর থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক। তিনি বললেন, রাতভর এ বাড়ি থেকে পুলিশের সঙ্গেই গোলাগুলি হয়েছে। বাড়ির ভেতরে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, একজন মারাও গেছে। যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম সুমন, মনু জমিদারের ছোট ছেলে। গোলাগুলি থামার পর পুরো বাড়ি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। এখন ঘরে ঘরে তল্লাশি চলছে।

ওসিকে বললাম, বাড়ির ভেতরে যেতে চাই। তিনি আমাকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। দেখি পুরো বাড়ি পুলিশে ভরা। একটি কক্ষে পুলিশের সঙ্গে সুদর্শন এক যুবক তর্ক করছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতে সেই যুবক এগিয়ে এসে বললেন, তাঁর নাম মোহাম্মদ শাহাদত, এ বাড়ির মালিকের তৃতীয় ছেলে। ঘরভর্তি পুলিশের সামনেই তিনি অভিযোগ করলেন, বিনা কারণে পুলিশ তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে রাতভর গুলি ছুড়েছে। সেই গুলিতে তাঁর ছোট ভাই সুমন মারা গেছে, আরেক ভাই শামিম ও ভাতিজা তুলি আহত হয়েছে। দেখলাম পুলিশ সদস্যদের কেউ তাঁর কথা গ্রাহ্য করছেন না। কিন্তু তিনি বারবার অভিযোগ করেই যাচ্ছেন।

বাড়ির ভেতরটা ভালো করে দেখলাম, এত যে গুলি হয়েছে, তার তেমন কোনো চিহ্ন নেই। মনে হলো পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগ শূন্যে গুলি ছুড়েছেন। শাহাদত বললেন, তিনি জানালা দিয়ে দেখেছেন, রাতে পুলিশের সঙ্গে আবুল, ইবন ও জাকির নামের তিনজন সন্ত্রাসীও ছিল। তারাও গুলি করেছে। সেই তিনজন কারা? প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, এরা কালা জাহাঙ্গীরের সহযোগী। শাহাদতের মুখে কালা জাহাঙ্গীরের নাম শুনে মনে হলো, পেছনে বড় ঘটনা আছে। কালা জাহাঙ্গীর তখন ঢাকা আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘অদৃশ্য ডন’। একের পর এক খুন করে যাচ্ছেন, কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরতে পারছে না।

সকাল নয়টার দিকে ঘটনাস্থলে এলেন ডিবির তখনকার ডিসি মুহাম্মদ আবদুল হান্নান। তিনি এসে সব খোলাসা করলেন। বললেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী আসিফ তাঁর দলবল নিয়ে মনু জমিদারের বাড়িতে অবস্থান করছেন জেনেই তাঁরা অভিযান করেছেন, কিন্তু আসিফকে তাঁরা ধরতে পারেননি। ডিসি জোর দিয়ে বললেন, দুদিন ধরে তাঁরা বাড়িটি রেকি করেছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি (২০০০ সাল) রাত নয়টার দিকে আসিফ তাঁর দলবল নিয়ে এ বাড়িতে আসেন। এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর রাত তিনটার দিকে তাঁরা অভিযান শুরু করেন। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, এ বাড়িতে শীর্ষ সন্ত্রাসী আসিফ ছিলেন। কিন্তু অভিযানের সময় সুযোগ বুঝে পেছনের দরজা দিয়ে দলবল নিয়ে পালিয়ে গেছেন। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও সাংবাদিকদের একই কথা বলেছিলেন।

মনু জমিদারের পরিবার এলাকায় অনেক প্রভাবশালী। পুলিশের গুলিতে সুমন নিহত হওয়ার পর এলাকায় বেশ উত্তেজনা দেখা দেয়। পরের দিন লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করে। পুরো পোস্তগোলায় দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। আমাদেরও কাজ বেড়ে গেল। পোস্তগোলায় এসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেই বেরিয়ে এল অনেক তথ্য।

মনু মিয়ার যে সুদর্শন সন্তানের কথা বললাম, সেই শাহাদত সেবার ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সেখানকার প্রভাবশালী ওয়ার্ড কমিশনার সাইদুর রহমান ওরফে শহীদ কমিশনার নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে চান। স্বাভাবিকভাবেই শাহাদত নির্বাচনে আসুন, তা তিনি চান না। শাহাদত যেখানে যান, সেখানেই তিনি লোক পাঠিয়ে গোলযোগ করার চেষ্টা করেন। এ রকম গোলযোগের সময় বাবু নামের এক যুবক নিহত হন। সেই মামলায় শাহাদতকে প্রধান আসামি করা হয়। শাহাদত আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় অবস্থান করছেন।

লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, জামিনে এসে শাহাদত শীর্ষ সন্ত্রাসী আসিফের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছেন। আসিফের লোকজন দিনরাত তাঁকে চোখে চোখে রাখছে, যাতে শহীদ কমিশনারের সন্ত্রাসীরা ছুঁতে না পারে। শহীদ কমিশনারও কম নন, তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরকে আশ্রয় দিয়েছেন। কালা জাহাঙ্গীর এখন তাঁর হয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

শাহাদতের বাড়িতে পুলিশি অভিযানের পর কালা জাহাঙ্গীরের সুবিধা হয়েছে। আসিফ তাঁর দলবল নিয়ে পোস্তগোলা ছেড়ে খিলগাঁওয়ে আস্তানা গেড়েছে। এতে করে কালা জাহাঙ্গীরের পুরান ঢাকায় আশ্রয় আরও নিরাপদ হয়েছে। আসিফ অনেকবার পুরান ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এ নিয়ে অনেক দেনদরবার হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। একপর্যায়ে আসিফের আস্তানার খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠেন কালা জাহাঙ্গীর।

এ জন্য তাঁকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ছয় মাসের মাথায় আসিফের এক বান্ধবীকে খুঁজে বের করেন কালা জাহাঙ্গীর। তাঁর সাহায্য নিয়ে একদিন আসিফের বাসায় হানা দেয় কালা জাহাঙ্গীরের দলবল। তারা আসিফ, তাঁর বডিগার্ড টিপু ও রিপনকে খুন করে দরজায় তালা দিয়ে সটকে পড়ে। ২০০০ সালের ২৯ আগস্ট সেই বাসা থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার পর পুলিশ লাশের সন্ধান পায়। কিন্তু তারপরও কালা জাহাঙ্গীর শান্ত থাকতে পারেননি। আসিফ খুনের এক মাসের মাথায় ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে খুন করেন হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে।

এসব ঘটনার পরে শাহাদত খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেন। তিনি কালা জাহাঙ্গীরের সব তৎপরতা নজরে রাখেন। বিএনপির তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বিভিন্নভাবে শাহাদতকে সহায়তা করেন। একসময় বিপুল ভোটে ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে শাহাদত নির্বাচিত হন। তারপরও কালা জাহাঙ্গীর তাঁর পিছু ছাড়েননি। ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তরার একটি স্কুলে ছেলেকে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিমানবন্দর সড়কে গাড়িতে গুলি করে শাহাদতকে খুন করেন কালা জাহাঙ্গীর। এরপর জনকণ্ঠ অফিসে ফোন করে সেই খুনের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু প্রতিপক্ষদের এভাবে হত্যা করেও বাঁচতে পারেননি ভয়ংকর কালা জাহাঙ্গীর। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর মা পেয়ারা বেগম র‍্যাব সদর দপ্তরে হাজির হয়ে বলেন, তাঁর ছেলে কালা জাহাঙ্গীর ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। এর পর থেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে কালা জাহাঙ্গীরের তৎপরতা থেমে যায়। এরপর তাঁর আশ্রয়দাতা সেই শহীদ কমিশনারও একটি মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ নিয়ে পলাতক হন।

শাহাদত খুনের মামলার শেষ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। কালা জাহাঙ্গীরের ভয়ে কেউ আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাননি। আদালত একপর্যায়ে আসামিদের অব্যাহতি দেন।

শাহাদতের তিন ছেলে লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরেছেন। তাঁরা এখন ব্যস্ত নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’ লেখার আগে ফোন করেছিলাম শাহাদতের আইনজীবী ও স্বজন রফিকুল ইসলামকে। তিনি বললেন, অন্ধকার জগতের সব আঁধার কেটে গেছে। শাহাদতের পরিবার এখন আলোতে, তাঁরা ভালোই আছেন।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত