Ajker Patrika

লিমনের মধুর প্রতিশোধ

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১৬
Thumbnail image

আপনি যে সাংবাদিক তার কোনো প্রমাণ আছে? পঙ্গু হাসপাতালের ভেতরের একটি অপারেশন থিয়েটারের সামনে এ প্রশ্ন করলেন এক যুবক। বললাম, কার্ড আছে, সেটা তো গাড়িতে। নিয়ে আসব?

যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, তার পাশে একটি বিছানা রাখা। এক ছেলে সেই বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন পাশে থাকা এক বয়স্ক লোক, এক নারী আর পাহারায় থাকা দুই পুলিশ সদস্য।

আমার কথা শুনে কান্না থামিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলেটি পরিচয় জানতে চাইল। আবার বললাম, আমি একজন সাংবাদিক। আপনার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছি। ছেলেটির পাহারায় থাকা দুই পুলিশ সদস্যের একজন কথা বলতে বাধা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কী কারণে অন্যজন তাঁকে থামিয়ে দিলেন? ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ শুরু হলো। এটা ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল সকালের কথা।

এই ছেলের নামই লিমন হোসেন। আপনাদের অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, র‍্যাবের গুলিতে পা হারানো সেই লিমনের কথা? আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’-এর নায়ক সেই লিমন। তবে সেই দিনের ১৬ বছরের লিমন এখন অনেক পরিণত। লেখাপড়া শেষ করে গতকাল বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। রাতে এ গল্প লেখার সময় বউ নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন লিমন।

এমনিতেই পঙ্গু হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা খুব সহজ নয়। হাসপাতালে অভ্যর্থনাকেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো তথ্য থাকে না। তবে কী কারণে যেন সহজেই লিমনের খোঁজ পেয়ে গেলাম। কিন্তু ওয়ার্ডে গিয়ে তাঁকে আর পেলাম না। একজন বললেন, জরুরি অপারেশন আছে, তাঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। এলাম নিচতলায় অপারেশন থিয়েটারের সামনে। শুরুতে যে যুবক আমাকে জেরা করেছিলেন, তিনি লিমনের মামা এরশাদ।

লিমনের খোঁজ পেলাম কী করে, সে এক গল্প। পুলিশের নগর বিশেষ শাখায় প্রতিদিন রাজধানীর পরিস্থিতি নিয়ে একটি করে প্রতিবেদন তৈরি হয়, যার পরিচিত নাম ডিআর বা ডেইলি রিপোর্ট। সেই প্রতিবেদন কপি যায় পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তির কাছে। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর লিমন হোসেনের খবরও সম্ভবত সেই প্রতিবেদনে এসেছিল। আমি সেটা দেখিনি, তবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে সেই ঘটনা জানিয়ে ভালো করে খোঁজ নিতে বলেছিলেন।

বিকালে অফিসে এসে মফস্বল বিভাগে কথা তুলতেই একজন বললেন, এটা বাসি খবর। ঝালকাঠি প্রতিনিধি দুই দিন আগে পাঠিয়েছেন, কিন্তু ছাপা হয়নি। সেই রিপোর্ট হাতে নিয়ে দেখি, ক্রসফায়ারের পর বাহিনীগুলো যেভাবে ঘটনার বিবরণ দিয়ে থাকে, ঠিক সেভাবেই এ ঘটনারও বিবরণ। ফোন দিলাম প্রথম আলোর তৎকালীন ঝালকাঠি প্রতিনিধি আক্কাস শিকদারকে। তিনি বললেন, দুই দিন আগে লিমনের মা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। আক্বাস শিকদারের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিলেন এবিসি রেডিওর সাংবাদিক, বর্তমানে নেক্সাস টিভির কারেন্ট অ্যাফেয়ার এডিটর আমিন আল রশীদ। বললেন, আমিন আর তিনি পরদিন ঘটনাস্থলে যাবেন।

প্রথম আলোর অপরাধ বিভাগের রিপোর্টার, বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আনিছকে বললাম আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তিনি রাজি হলেন। ৯টার দিকে তাঁর বাইকে চেপে রওনা দিলাম পঙ্গু হাসপাতালের দিকে। আকাশে তখন প্রচণ্ড মেঘ। কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেটে যেতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। কাজী আনিছ চিৎকার শুরু করে দিলেন–ভাই, ভিজে গেলে আমার জ্বর এসে যাবে। অগত্যা অভিযান ক্ষান্ত দিয়ে কাকভেজা হয়ে অফিসে ফিরে এলাম। গেলাম পরদিন সকালে।

 

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ওই দিনই লিমনের এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। তখন তার বাঁ পা কেটে ফেলা হয়েছে। লিমন আমাকে বললেন, তাঁর বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে। বাবা দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেন। পরিবারের সবার ছোট তিনি। পড়তেন কাঁঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজে। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে তিনি মাঠ থেকে গরু আনতে বাড়ির বাইরে যান। পথে স্থানীয় শহীদ জমাদ্দারের বাড়ির সামনে র‍্যাব-৮-এর একটি দল তাঁকে থামিয়ে শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র পরিচয় দেন। কিন্তু র‍্যাবের এক সদস্য কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তাঁর বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে দেন। লিমন সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ২৪ মার্চ লিমনকে রাজাপুর হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২৫ মার্চ লিমনকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। ২৭ মার্চ চিকিৎসকেরা লিমনের বাঁ পায়ের হাঁটু থেকে কেটে ফেলেন। লিমনের সঙ্গে আমার দেখা হয় তারও আট দিন পর।

লিমন প্রথমে বললেন, ‘আমি গরিব বাবা-মায়ের ছেলে। কষ্ট করে লেখাপড়া করি। লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য বাড়ির পাশে ইটভাটায় কাজ করি। মানুষের কাছ থেকে জামাকাপড় চেয়ে নিয়ে কলেজে যাই। র‍্যাব কোনো কথা না শুনেই আমার পায়ে গুলি করে বলে, তুই সন্ত্রাসী।’ পাশে থাকা পুলিশ সদস্য আমাকে বললেন, লিমনের চিকিৎসার জন্য গ্রামের সবাই সাহায্য করেছেন। যাঁদের কাছে নগদ টাকা নেই, তাঁরা চাল-ডালও দিয়েছেন।

পায়ে গুলি করার পর লিমনের বিরুদ্ধে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করা হয়। একটি অস্ত্র আইনে, অন্যটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে। দুটি মামলাতেই লিমনকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। বলা হয়, লিমন এলাকার সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের সহযোগী। র‍্যাব-৮-এর তখনকার অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মনিরুল হক। আমি তাঁকে ফোন দিতেই তিনি খুব জোর দিয়ে বললেন, লিমন সন্ত্রাসীর সহযোগী—এ ব্যাপারে তাঁর কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। এরপর দীর্ঘ সময় চেষ্টা হয়েছে লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমাণের।

লিমনকে নিয়ে আমার রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় ৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘নিষ্ঠুর নির্যাতন’ শিরোনামে। রিপোর্টটি প্রকাশের পর সারা দেশে হইচই পড়ে যায়। ওই দিনই সকালে পঙ্গু হাসপাতালে লিমনকে দেখতে যান তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি লিমনের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর দেশ-বিদেশের মানুষ লিমনের পাশে দাঁড়ান। আইন ও সালিশ কেন্দ্র লিমনকে দেখভাল করতে শুরু করে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র লিমনের লেখাপড়া ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলা রাষ্ট্রপক্ষ প্রত্যাহার করে নেয়।

ধীরে ধীরে লিমনের জীবনে সুদিন আসে। সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন। এরপর কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেন। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গণবিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে শিক্ষা সহকারী হিসেবে যুক্ত হন। আর ২০২০ সালের ১ আগস্ট প্রভাষক হন লিমন। লিমন গতকাল বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছেন।

মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত। উত্থান-পতনের লেখচিত্রে তা সতত গতিশীল। লিমনের এই ঘুরে দাঁড়ানো যেন সব অনাচারের বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ। আহা, জীবন আসলেই সুন্দর!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত