Ajker Patrika

ট্রাম্পের শুল্কনীতি যেসব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াবে

ট্রাম্পের মতে, শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক পাচার বন্ধ করতে সহায়ক হবে। ছবি: এএফপি
ট্রাম্পের মতে, শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক পাচার বন্ধ করতে সহায়ক হবে। ছবি: এএফপি

শপথের দিনই মেক্সিকো-কানাডা-চীনের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী বছর মুদি পণ্য থেকে শুরু করে মদ্যপানীয়ের দামও বাড়তে পারে। এ ছাড়া কৃষিপণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি সংকটও দেখা দিতে পারে।

মার্কিন কৃষি বিভাগ এবং মার্কিন শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দুটি দেশ মেক্সিকো ও কানাডা। গত বছর এ দুই দেশ থেকে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশ দুটির ওপর শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ ব্যবস্থায় আর্থিক ও অবকাঠামোগত প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। বিশেষ করে জনগণের চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর কতটা নির্ভরশীল সেটি প্রকাশ্যে চলে আসবে।

ফ্রেশ প্রোডিউস অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য আমেরিকাসের প্রেসিডেন্ট ল্যান্স জুংমেয়ার বলেন, শুল্ক আরোপ হলে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্য ও খাবারের দোকানগুলোতে। গ্রাহক তাজা শাক-সবজি-ফল পাবেন না। রেস্টুরেন্টগুলোকে খাবারের তালিকা নতুন করে সাজাতে হবে। খাবারের ধরন ও পরিমাণেও আসবে পরিবর্তন। খাবারের দাম বাড়লেও পরিমাণ কমে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সবজি এবং অর্ধেক ফল ও বাদাম মেক্সিকো থেকে আসে। দেশটির কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯০ শতাংশ অ্যাভোকাডো, ৩৫ শতাংশ কমলার জুস ও ২০ শতাংশ স্ট্রবেরি আসে প্রতিবেশী মেক্সিকো থেকে।

মেক্সিকোর প্রধান অ্যাভোকাডো উৎপাদনকারী এলাকা মিচোয়াকান রাজ্যের গভর্নর আলফ্রেডো রামিরেজ বলেন, এই শুল্ক আরোপ মূল্যস্ফীতি ক্রমেই বাড়াতে থাকবে। যার প্রভাব পড়বে গ্রাহকদের ওপর। চাহিদা কমবে না কিন্তু বাড়বে দাম ও ব্যয়।

ইউএস বাণিজ্য ডেটা থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাভোকাডো আমদানি বেড়ে গিয়ে ৪৮ শতাংশে পৌঁছায়। গ্রাহকেরা সালাদ ও স্যান্ডউইচে অ্যাভোকাডো ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে আমদানি বাড়াতে হয়। ইউএসডিএ জানায়, মেক্সিকোর মোট অ্যাভোকাডো রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসে, যার বাণিজ্য মূল্য ৩ বিলিয়ন ডলার।

শুল্ক আরোপের প্রভাবে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়ের মূল্যও বেড়ে যাবে বলে জানান অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্টিলড স্পিরিটস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকো থেকে আমদানি করা কৃষিপণ্যের মোট আমদানির প্রায় এক চতুর্থাংশ ছিল বিয়ার ও টাকিলা। ৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের মেক্সিকান টাকিলা ও মেজকাল ছিল এ তালিকায়। মেজকাল মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী পানীয় মার্গারিটার মতো ককটেল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ দুটি থেকে আমদানি করা পানীয় ও পানীয় তৈরির কাঁচামালের ওপর শুল্ক আরোপ করা গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিকর হবে। পর্যটন শিল্পও ক্ষতির মুখে পড়বে। দেশের পর্যটন ব্যবসাগুলো এখনো মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের গভীর প্রভাব পড়বে দেশটির গবাদিপশুর ব্যবসায়। মেক্সিকো থেকে প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি গরু আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র, যা দেশের বাজারে মাংস সরবরাহের বড় একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কৃষক ও গবাদিপশু উৎপাদকদের সংস্থা আর-কাফ ইউএসএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিল বুলার্ড বলেন, দেশীয় উৎপাদকেরা সম্প্রতি তাঁদের গরুর উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন, ফলে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। শুল্ক আরোপের ফলে গবাদিপশু ও গরুর মাংসের আমদানি কমে গেলে স্থানীয় উৎপাদকেরা লাভবান হতে পারেন।

বুলার্ড আরও বলেন, শুল্কের ফলে মাংসের দাম বাড়তে পারে। আমদানিকারক ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীদের অতিরিক্ত খরচ হবে। তবে আমরা শুল্কের অপেক্ষায় রয়েছি। এটি স্থানীয় উৎপাদকদের পথ সুগম করবে। এ ছাড়া শূকর, গরু ও দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদিপশুর বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। যার ফলে উভয় দেশের উৎপাদকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

কানাডা পর্ক কাউন্সিল ও ম্যানিটোবা পর্ক কাউন্সিল জানায়, প্রতি বছর আইওয়া, মিনেসোটা, সাউথ ডাকোটা ও নেব্রাস্কায় প্রায় ৩০ লাখ শূকর ছানা রপ্তানি করে ম্যানিটোবা। এসব জায়গায় সস্তায় ফিড কর্ন (পশুখাদ্য) পাওয়া যায়। সেখানে লালনপালনের পর বড় হলে শূকরগুলোর মাংস প্রক্রিয়াজাত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বাজারে পাঠানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ জানায়, ২০২৫ সালে দেশটিতে কৃষি বাণিজ্যে ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঘাটতি হতে পারে। মেক্সিকোতে উৎপাদিত স্ট্রবেরি, টমেটোর মতো যেসব পণ্য মৌসুমি পণ্য নয়, সারা বছর বাজারে পাওয়া যায়—এমন পণ্য এবং আমদানি করা মদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষি বাণিজ্যের সংগঠন আমেরিকান ফার্ম ব্যুরো ফেডারেশনের পাবলিক পলিসি ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যাম কিফার বলেন, শুল্কের কারণে কানাডা থেকে আমদানি করা সারের দামও বাড়তে পারে। বর্তমানে চাষিদের যে দামে সার কিনতে হচ্ছে, ২০২০ সালের আগে তার প্রায় ৫০ শতাংশ কম ছিল। এই শুল্ক আরোপের ধাক্কা সহ্য করতে কৃষি অর্থনীতি এখনো প্রস্তুত নয়।

হোল্যান্ড অ্যান্ড নাইট–এর একজন আইনজীবী এবং সিনিয়র নীতি পরামর্শক এবং সাবেক ইউএসডিএ বাণিজ্য কর্মকর্তা পিটার ট্যাবর বলেন, ২০২৬ সালের ইউএসএমসিএ বাণিজ্য চুক্তির আগে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কাজে আসতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে এই কঠোর শুল্ক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দেশটির আমদানিকারক ও দেশটিতে রপ্তানিকারীরা বিকল্প খুঁজতে শুরু করবে।

গত সোমবার ট্রাম্প বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ওপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করবেন। ট্রাম্পের মতে, এই শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক পাচার বন্ধ করতে সহায়ক হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত