Ajker Patrika

দক্ষিণ এশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট হাব

মাতারবাড়ী বদলে দেবে বাংলাদেশকে

  • প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি কাল।
  • নির্মাণ করবে জাপানের পেন্টা-ওশান কনস্ট্রাকশন ও টিওএ করপোরেশন।
  • পণ্য পরিবহনে খরচ কমবে প্রায় ৫৭ শতাংশ, সময় সাশ্রয় হবে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত।
 আবু বকর ছিদ্দিক, চট্টগ্রাম
বঙ্গোপসাগর তীরে মহেশখালীর এই অংশে নির্মিত হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। ইনসেটে প্রস্তাবিত নকশা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বঙ্গোপসাগর তীরে মহেশখালীর এই অংশে নির্মিত হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। ইনসেটে প্রস্তাবিত নকশা। ছবি: আজকের পত্রিকা

দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বদলে দিতে যাচ্ছে মাতারবাড়ী। বহুল কাঙ্ক্ষিত গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি এখন আর কাগজে আঁকা স্বপ্ন নয়, সেটি বাস্তবায়নের মোক্ষম বাঁক পেরিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে নির্মাণপর্বে। এ লক্ষ্যে আগামীকাল মঙ্গলবার ঢাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাপানের দুটি বড় নির্মাণ কোম্পানি পেন্টা-ওশান কনস্ট্রাকশন ও টিওএ করপোরেশনের মধ্যে চূড়ান্ত নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

বন্দরটি শুধু একটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প নয়, বরং এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, যার গভীরতা ও সক্ষমতা চট্টগ্রামকেও ছাড়িয়ে যাবে। সরাসরি নোঙর করতে পারবে ৮ হাজারের বেশি টিইইউস ধারণক্ষমতার কনটেইনার জাহাজ। এতে কমবে সময়, বাঁচবে টাকা, বাড়বে প্রতিযোগিতা।

চট্টগ্রামের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গভীরে বাংলাদেশের উত্তরণ

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফটের ও ৩০ হাজার টনের বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারে না। সেখানে মাতারবাড়ী বন্দর প্রথম পর্যায়েই ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ গ্রহণে প্রস্তুত। এই এক পার্থক্যই বদলে দেবে দেশের পণ্য পরিবহনের সমীকরণ।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক ধাপ। নির্মাণকাজ দ্রুতই শুরু হবে এবং ২০২৯ সালের মধ্যেই মাতারবাড়ীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

সময় ও খরচে বিপ্লব

মাতারবাড়ী চালু হলে পণ্য পরিবহনে খরচ কমবে প্রায় ৫৭ শতাংশ, সময় সাশ্রয় হবে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। এখন ইউরোপে একটি কনটেইনার পাঠাতে গড়ে খরচ পড়ে ৩ হাজার ডলার এবং সময় লাগে ৪০-৪২ দিন। মাতারবাড়ীতে বৃহৎ জাহাজ সরাসরি নোঙর করতে পারলে এই খরচ নামবে ১ হাজার ৩০০ ডলারের নিচে এবং সময় কমে আসবে প্রায় দুই সপ্তাহ।

যেটা আগে হতো সিঙ্গাপুর বা কলম্বো ঘুরে, এখন সেটি হবে সরাসরি মাতারবাড়ী থেকে।

মাতারবাড়ী হবে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র

এই বন্দর কেবল দেশের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্যই হবে একটি নতুন হাব। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী চালু হলে ভারত, নেপাল, ভুটানও এ বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশে ট্রান্সশিপমেন্ট সেবা নেবে তারা আর আমরা আয় করব কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা।’

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন জানান, কলকাতা ও হলদিয়া থেকেও ফিডার জাহাজ এসে পণ্য আনতে পারবে। এই পুরো কাঠামো তৈরি হলে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান এক ধাপে এগিয়ে নেবে।’

বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বন্দর—এক অবকাঠামো, দুই ভবিষ্যৎ

মাতারবাড়ীর মূল চিত্র বদলাতে শুরু করেছে আগেই। এখানে তৈরি হওয়া ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নেভিগেশনাল চ্যানেল এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বন্দর কার্যক্রমে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ইতিমধ্যে ভিড়েছে ১৬১টি জাহাজ, পরিবহন হয়েছে ৩ দশমিক ২৯ মিলিয়ন টন পণ্য। এই অবকাঠামো এখন বন্দরকে দিচ্ছে এক প্রস্তুত প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে বাংলাদেশ পা রাখবে গভীর সমুদ্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে।

ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু লক্ষ্য অটুট

প্রকল্পটি শুরুতে অনুমোদন পেয়েছিল ২০২০ সালে। তবে জমি অধিগ্রহণ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পিছিয়ে পড়ে নির্মাণকাজ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে একনেক প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন করে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় উন্নীত করে। বাড়তি ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কারণ—ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সরঞ্জামের ব্যয় এবং সময়ক্ষেপণজনিত খরচ। তবু থেমে যায়নি পরিকল্পনা। বরং আরও শক্ত ভিত্তিতে এগোচ্ছে দেশ।

যোগাযোগ বাড়ছে, সঙ্গে সক্ষমতাও

বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক সংযোগ তৈরি করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নতুন রোড নির্মাণের পরিকল্পনায় রয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্ভাব্যতা যাচাই ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, তৃতীয় পর্যায়ে যুক্ত হবে টাগবোট, পাইলট বোটসহ আধুনিক সমুদ্রযান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত