Ajker Patrika

অর্থনীতি টেনে তোলাই চ্যালেঞ্জ

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
অর্থনীতি টেনে তোলাই চ্যালেঞ্জ

দেশের অর্থনীতি প্রায় ভঙ্গুর। ঋণখেলাপিতে বিপর্যস্ত ব্যাংক খাত। ডলার-সংকটে রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে। পাহাড়সম বিদেশি ঋণ। রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ভাটার টান। গতিহীন রাজস্ব আয়। জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দামে মূল্যস্ফীতিও লাগামহীন। ছাত্র-জনতার আকস্মিক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামল শেষে এমনই ফোকলা অর্থনীতি সামলানোর ভার এসে পড়েছে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকারের ওপর। আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর এখন মন্দা অর্থনীতিকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জই বড় হয়ে আসছে সামনে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অর্থনীতিকে ঠিক জায়গায় আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে আরও খারাপের ঝুঁকি রয়েছে। অবশ্য উদ্যোক্তারা তড়িঘড়ি না করে নতুন সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে। 

সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা যায়, একসময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উঠে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত এটা ধরে রাখতে পারেনি। সদ্য বিদায়ী জুলাই মাসেই রিজার্ভ কমেছে ১৩০ কোটি ডলার। দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন গভর্নরের অন্যতম চ্যালেঞ্জই হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়িয়ে আমদানি সহজলভ্য করা, যাতে বিনিয়োগ বাড়ে, উৎপাদন খাত চাঙা হয় ও মানুষের কর্মসংস্থানে গতি আসে।

ডলার বাড়ানোর বড় খাত রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে বেশ কিছুদিন ধরেই ভাটার টান চলছে। দেশে ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আসে জুলাইয়ে। জুনের তুলনায় গত মাসে ৬৩ কোটি ডলার বা প্রায় ২৫ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে। এখন নতুন সরকারের বড় দায়িত্ব হয়ে পড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহকে স্বাভাবিক করে রিজার্ভের মজুত বাড়ানো। 

সাম্প্রতিক সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইমেজ সংকট তৈরি হওয়ার কারণে কয়েক মাস ধরেই পোশাকের ক্রয়াদেশ কমছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই পোশাক রপ্তানিতে ইমেজ সংকট পুনরুদ্ধারসহ নতুন বাজারের প্রসার ঘটানোই হবে চ্যালেঞ্জ।

নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন সরকারকে সময় দিতে হবে। কারণ, অর্থনীতিতে এতগুলো সংকট সহসাই তাঁরা সমাধান করতে পারবেন, এমন আশা করা ঠিক হবে না। আমার প্রত্যাশা হলো, সরকার যেন ধীরেসুস্থে কাজগুলো করে। গত এক মাসে আমাদের ইমেজের ক্ষতি হয়েছে। এটা মেরামত করতে হবে।’

আগের সরকার গত ১৫ বছরে বিদেশি ঋণ করেছে সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া সুদে-আসলে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার পাহাড়সমান সরকারি ঋণ নতুন সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ছে। এই ঋণ অন্তর্বর্তী সরকারের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি হরিলুটের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ছিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর অপর চ্যালেঞ্জই হলো এই খাতে সুশাসন ফেরানো। 

আগের সরকারের ওপর দেশের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ছিল জিনিসপত্রের লাগামহীন দামের বিষয়টি। বছরজুড়ে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ অনেকটাই পিষ্ট। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এমন অবস্থায় মানুষের চাওয়া পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। 

কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির গতিহীনতার জন্য সরকারের রাজস্ব আদায়েও গতি ছিল না। ফলে প্রতিবছরই উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বড় ঘাটতি পড়ে। সর্বশেষ বিদায়ী অর্থবছরেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি আগের সরকার। ফলে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি পড়ে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। 

অর্থনীতিতে যেভাবে সংকট বাড়ছে, সে সময়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় না বাড়লে দায়দেনার পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন নতুন সরকারকেও দেশ পরিচালনা ও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দেশি-বিদেশি উৎসের কাছে হাত পাততে হবে। 

নতুন সরকারের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধ করে একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সবার মধ্যে আস্থা ফেরানো। এরপর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা। কারণ, সরকার যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে আমাদের কপালে কিন্তু আরও খারাপ আছে। আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ব্যবসায় আক্রমণ ও দখলদারি আছে। নতুনরা সক্রিয় হচ্ছে। এগুলো কত দ্রুত থামানো যাবে, সেটা দেখতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত