Ajker Patrika

রুপালি ইলিশেই সমৃদ্ধি

ড. বিমল চন্দ্র দাস
আপডেট : ২৮ জুন ২০২১, ১৫: ০৩
রুপালি ইলিশেই সমৃদ্ধি

মাছের রাজা ইলিশ বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক। এটি শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ব্যাপক সমাদৃত। ইলিশ এখন বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য, যার স্বত্বাধিকারী শুধু বাংলাদেশই। ইলিশের আলোচনা এলেই যে শহরের নাম প্রথম উচ্চারিত হয়, তা হলো বরিশাল। ‘ধান-নদী-খাল—এই তিনে বরিশাল।’ বরিশাল ১২টি ছোট–বড় নদী দ্বারা বেষ্টিত। এ নদীগুলোর তীরে বাস করে বর্তমানে ৭৪ হাজার ২৫৯টি জেলে পরিবার, যাদের পরিশ্রমে নদী থেকে সারা বছর আহরিত হয় সুস্বাদু ইলিশ। ফলে সমৃদ্ধ হচ্ছে বরিশাল ও এর মানুষ, আন্তর্জাতিক পরিসরে সমাদৃত হচ্ছে দেশ।

ইলিশে একাকার ১৭ বছরছোটবেলা থেকেই ইলিশের প্রতি দুর্বলতা ছিল ভীষণ। তখন বরিশালের ইলিশ ধরা দেখার সুযোগ না হলেও বড় বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় ইলিশ ধরা দেখার সুযোগ হয়েছিল। শিক্ষাজীবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে মৎস্যবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান) ও এমএস (একুয়াকালচার) ডিগ্রি অর্জন করি। তখন সরকার ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম বেগবান করতে ‘চতুর্থ মৎস্য প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এতে মৎস্য কর্মকর্তা (হিলসা) নামে তিনটি পদে কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। ইলিশের প্রতি দুর্বলতা থাকায় ওই পদে আবেদন করি এবং সৌভাগ্যক্রমে নিয়োগ পাই। এই পদে বরিশালে ২০০৪ সাল থেকে কাজ করছি। সুযোগ আসে বরিশালের ইলিশ নিয়ে কাজ করার। চেষ্টা করি ইলিশের সংরক্ষণ থেকে শুরু করে এর আদি-অন্ত জানার। একই সঙ্গে চলে গবেষণাও। মেঘনাসহ বরিশালের বিভিন্ন নদীতে টানা ১৭ বছর কেটেছে। জীবনের সঙ্গে বরিশালের এই রুপালি ইলিশ ও নদী যেন একাকার হয়ে গেছে।

বরিশাল জেলায় ১২টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে কীর্তনখোলা, মেঘনা, কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ, মাসকাটা, গজারিয়া, নয়া ভাঙনী, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, কারখানা ও পাণ্ডব নদেই বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। নদীগুলো থেকে ২০১০ সালে ইলিশ আহরণ হতো ২৫ হাজার মেট্রিক টন। ১০ বছর পর এর পরিমাণ ৫২ শতাংশ বেড়ে ৩৮ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এ আহরণের সঙ্গে যুক্ত ৭৫ হাজার ৬৯১ জন জেলে। এই মানুষদের জীবনের সঙ্গে ইলিশ একেবারে মিলেমিশে একাকার। পাশাপাশি হাজার হাজার মৎস্য ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ইলিশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে নানাভাবে। যেমন ইলিশ পরিবহন, প্যাকেজিং, ইলিশের ডিম বিক্রি, ইলিশের আঁশ বেচাকেনা, নোনা ইলিশসহ নানা সেক্টরে বরিশালের অসংখ্য মানুষ জড়িত। সারা বিশ্বে যে সুস্বাদু নদীর ইলিশের কদর, তা বরিশাল থেকেই রপ্তানি হয়। স্বাদের ইলিশ বলতে বরিশালের ইলিশকেই বোঝায়।

এই ইলিশ আহরণের মূল চালিকাশক্তি জেলেরা। জেলেদের সংগ্রামী জীবন নদীর তীরে গিয়েই কেবল উপলব্ধি করা সম্ভব। জেলেপাড়ার চিত্রও অন্য রকম। দেনায় জর্জরিত জেলেরা রাত-দিন নদীতেই কাটান। ঝড়–ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে গভীর নদী থেকে সাগর মোহনায় ইলিশ শিকার করেন তাঁরা।

অনেক সময় টানা ১৫-২০ দিন কেবল ইলিশ খেয়েই জেলেরা নদীতে টিকে থাকেন। বছরের একটি বড় সময় নিষেধাজ্ঞার কারণে বেকার হয়ে পড়েন তাঁরা। আবার জীবনযুদ্ধে উত্তাল নদীতে নেমে পড়েন হাজার হাজার জেলে। 

জাল ভরে ইলিশ ধরে বরিশালকে সমৃদ্ধ করেন এই জেলেরাই। বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশকে সমৃদ্ধ করতে জেলেদের মানোন্নয়নে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে। 
বরিশালের সুস্বাদু ইলিশের আহরণ বাড়াতে বরিশালের মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন–সংক্রান্ত জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সব সদস্যকে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। জাটকা নিধন প্রতিরোধ কার্যক্রম, প্রজননক্ষম ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম, বেহুন্দিসহ ছোট ফাঁসের অন্যান্য ক্ষতিকর জাল নির্মূলে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে। অবরোধে জেলেদের জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিক রাখতে মানবিক সহায়তার আওতায় সরকার বিশেষ ভিজিএফ (চাল) প্রদান করে। শুধু তা–ই নয়, জাটকা বাঁচাতে এবং এদের সমুদ্রে যাওয়া অবাধ করতে বরিশালের তিনটি উপজেলার নদীর ৮২ কিলোমিটার এলাকাকে ষষ্ঠ মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই এলাকায় প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল দুই মাস মাছ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়। 

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হলে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। আর এ জন্য মৎস্য অধিদপ্তর সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ও ইলিশসম্পদ উন্নয়ন নামে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্প দুটি জেলেদের জীবিকা ও জীবনমান উন্নয়নে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করছে। 

শুধু জেলে নয় ইলিশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও বহু শ্রেণি–পেশার মানুষের জীবন। বরিশালের ইলিশের মানোন্নয়নে জেলেদের সঙ্গে নদী থেকে ইলিশ সংগ্রহকারী পাইকার, ঘাটের আড়তদার, ইলিশ পরিবহনকারী, আড়তদার, চালানকারী পাইকার, খুচরা বিক্রেতা, ইলিশ রপ্তানিকারকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ জড়িত। এসব মানুষকেও ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে নেওয়া বিশেষ প্রকল্পগুলোর বিবেচনায় নিতে হবে। 

২০১২ সালে রপ্তানি বন্ধ হওয়ার আগে বরিশাল থেকেই ইলিশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। গত বছর দুর্গাপূজায় ভারতে যে ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তারও ৭৫ শতাংশ ছিল বরিশালের। আজকাল ভরা মৌসুমে দূরদূরান্ত থেকে ইলিশ ধরা দেখতে বিশেষত তরুণেরা ছুটে আসছে। দল বেঁধে তারা নৌকায় চড়ে গভীর নদীতে যায়। ইলিশ ধরা দেখে এবং নৌকায় বসেই তাজা ইলিশ ভাজা খায়। চাঁদনি রাতে কীর্তনখোলা, মেঘনা নদীতে নৌ–ভ্রমণ আর ইলিশ খাওয়ার একটা চল তৈরি হয়েছে। এটি ক্রমে বরিশালের পর্যটনশিল্পের একটি জনপ্রিয় অংশ হয়ে উঠছে। যথাযথ উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হলে ভবিষ্যতে ইলিশকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের পর্যটনশিল্প গড়ে উঠতে পারে এ অঞ্চলে। এর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির চাকাও অনেকটা সচল হতে পারে। 

আমরা জানি, সবচেয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন ইলিশ হলো নদীর ইলিশ। বরিশালের নদীগুলো থেকেই এ সুস্বাদু ইলিশ আহরণ করা হচ্ছে। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে জাতীয় উৎসবগুলোতে বরিশালের ইলিশের যথেষ্ট কদর রয়েছে। এমনকি বিয়েসহ পারিবারিক অনুষ্ঠানেও ইলিশের চাহিদা সবার আগে। এ কারণে এই বরিশাল মৎস্য মোকাম থেকেই প্রতিদিন লোভনীয় ইলিশ প্যাকেটজাত হয়ে যাচ্ছে সারা দেশে। 

অদূরভবিষ্যতে মেঘনা, কীর্তনখোলাসহ বরিশালের এসব নদীই হবে ইলিশের খনি। কারণ, দেশের নদীতে মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬০ শতাংশই বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের। মানুষ পেটভরে খাবে স্বাদের ইলিশ। ইলিশ সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পৌঁছে যাবে নতুন উচ্চতায়। এর সঙ্গে ইলিশকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠলে এবং এতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তা এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। স্থানীয় জীবন ও জীবিকাতে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

ড. বিমল চন্দ্র দাস
মৎস্য কর্মকর্তা, জেলা মৎস্য দপ্তর, বরিশাল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পিটুনিতে নিহত সেই শামীম মোল্লাকে বহিষ্কার করল জাবি প্রশাসন, সমালোচনার ঝড়

১০-১২তম গ্রেডে নিয়োগ: প্রতি পদের বিপরীতে দুজন থাকবেন অপেক্ষমাণ

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

মধুপুরে বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষককে জুতাপেটা

র‍্যাবকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার ঠেকাতে হচ্ছে নতুন আইন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত