Ajker Patrika

‘ঈদ ঈদ’ বলে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরতাম

সেলিনা হোসেন
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ১৭: ৫৮
‘ঈদ ঈদ’ বলে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরতাম

আমার এখন ৭৫ বছর বয়স চলছে। এই সময়ের আগে আমার শৈশবের ঈদ ছিল প্রকৃতির সঙ্গে, একটা বিশাল জায়গায়। তখন পঞ্চাশের দশকে আমার আব্বার চাকরিসূত্রে আমরা থাকতাম বগুড়ার করতোয়া নদীপারের এক জায়গায়। অপূর্ব সুন্দর সেই জায়গাটি প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর। দিনরাত দৌড়ে-খেলে সেই শৈশবকে দেখেছি অনেক বড় জায়গায়। আমরা সেখানকার সব ছেলে-মেয়ে, যারা একসঙ্গে দশ-বারোজন খেলতাম, ঈদ এলে, বিশেষ করে রোজার পরে চাঁদ ওঠার দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আকাশে এক ফালি বাঁকা চাঁদ দেখলেই খুশিতে ‘ঈদ ঈদ’ বলে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরতাম।

তখনো ঈদের সময়ে সবাই নতুন জামা পেত না। অভাবী মানুষ তখনো ছিল। আমার আব্বা চাকরিসূত্রে একটু বড় জায়গায় ছিলেন। তাই তিনি আমাদের ভাই-বোনদের নতুন জামা দিতেন। কিন্তু যারা নতুন জামা পেত না, তাদের চোখের পানি দেখলে খুবই কষ্ট পেতাম। ভাবতাম, আমরা ঈদ উৎসবে আনন্দ করছি অথচ ওরা নতুন জামা না পেয়ে চোখের পানি ফেলছে! তাদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য ছিল না ঈদের সময় ওদের নতুন কাপড় দেওয়ার। কিন্তু এখন ভাবি, ওদের বাবা-মা যদি একটু পরিকল্পনা করে অন্য সময় জামা না দিয়ে ঈদের আগে দিতেন, তাহলে ওরাও ঈদ আনন্দে সমান ভাগীদার হতে পারত। তখন এতসব ভাবনা মাথায় আসত না বলেই এমন চোখের পানি দেখতে হতো।

এখন ৭৫ বছর বয়সে এসেও আমি যখন ঈদের সময় বাইরে তাকাই তখনো দেখতে পাই পথশিশুদের। তাদের গায়ে নতুন জামা নেই। আমার মেয়ে লারা বেঁচে থাকতে আমাকে বলত, ‘ওদের জন্য আলাদা করে পোলাও-মাংস রান্না করো। না হলে তোমার অতিথিদের কম পড়ে গেলে তুমি আমাকে বকাবকি করবে। এটা হবে না। তাই ওদের জন্য আলাদা রান্না করাই ভালো।’ আমি তা-ই করতাম। তারপর লারা আমার বাড়ির সামনে ওদের বসিয়ে খাওয়াত। এখন লারা নেই। লারার মৃত্যুর পরে একবার আমি ওদের ডেকেছিলাম। ওরা বলেছে, ‘না, লারা আপু মরে গেছে, আমরা আর এখানে আসব না।’ এইভাবে ওরা লারার জায়গাটাকে ধারণ করেছে নিজেদের মধ্যে।

এখনো নিজের বাড়িতেই ঈদ উদ্‌যাপন করতে চায় অধিকাংশ মানুষআমি মনে করি, আমার এ বছরের ঈদ উৎসব সেই আনন্দ-বেদনার সবটুকু নিয়েই আমার সামনে আসবে একটি অন্য রকম দিন হয়ে।

প্রসঙ্গত, এটাও বলে রাখি, আমি ১৯৬৪ সালে প্রথম লেখালেখি শুরু করি। রাজশাহীতে মেয়েদের কলেজে পড়তাম। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন বিভাগের সব কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। কলেজ থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তো সেখানে সাতটা আইটেমে আমার নাম দেওয়া হয়েছিল। একটা আইটেম ছিল গল্প লেখা। আমি তো আগে গল্প লিখিনি কখনো। কীভাবে গল্প লিখতে হয় তা-ও জানতাম না। চোখের পানি মুছে স্যারকে বললাম, ‘স্যার, এখান থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে দেন। আমি গল্প লিখতে পারব না।’ স্যার ধমক দিয়ে বললেন, ‘যা পারো লিখবে। তোমাকে ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড হতে হবে না। কিন্তু আমাদের কলেজের যে প্রতিনিধি, সে একটা গল্প লিখেছে, এইটা যেন আমরা মিস না করি।’ তারপর আমি অনেক চেষ্টা করে, অনেক ভেবেচিন্তে একটা গল্প লিখলাম। আশ্চর্যের বিষয়, পরে দেখা গেল বিচারকমণ্ডলীর বিবেচনায় আমার গল্পটি প্রথম হয়েছে।

এই ছিল আমার গল্প লেখার শুরু। এখন যখন ঈদসংখ্যায় লিখতে বলা হয় তখন আমি লিখি। এবং লিখলে মনে করি, এই ঈদসংখ্যায় লেখার একটা আনন্দ আছে। মানুষের হাতে যাবে লেখাটি, পড়বে সবাই আনন্দের সঙ্গে। এখনকার ঈদে এটাও আমার এক বড় আনন্দের বিষয়।

লেখক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি

অনুলিখন: সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত