Ajker Patrika

দারুণ সুযোগ অপেক্ষা করছে

ড. সুব্রত বোস
দারুণ সুযোগ অপেক্ষা করছে

শুরুটা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। ভারতের পুনেতে। মাত্র ৫০০ ডলার হাতে নিয়ে পাঁচ বন্ধু ও সহকর্মী মিলে সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান খুললেন, যার প্রধান নারায়ণ মূর্তি নামের এক স্বপ্নবাজ ইঞ্জিনিয়ার। নাম দিলেন ইনফোসিস। সারা বিশ্বে এখন এই কোম্পানির আড়াই লাখ কর্মী। বর্তমান বাজার মূলধন ৮০ বিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি আর তাঁর বন্ধুরা বুঝতে পেরেছিলেন আগামী বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি কীভাবে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সংকট অন্যদের তুলনায় অনেক আগেই তাঁরা অনুমান করেন। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতকদের কোম্পানিতে চাকরি দিতে শুরু করে ইনফোসিস। শুরুর দিকে এঁদের অনেকেরই সফটওয়্যার তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য ছিল। তবে সবাই অঙ্কে মোটামুটি ভালো। কয়েক মাসের প্রশিক্ষণে এঁদের সবাই হয়ে গেলেন কম্পিউটার প্রোগ্রামার।

পাশ্চাত্যের বড় বড় কোম্পানির জন্য এঁরা সফটওয়্যার তৈরি করেন; তথ্যপ্রযুক্তি–সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা প্রদান করেন। এভাবেই একের পর এক তথ্যপ্রযুক্তির কোম্পানি গড়ে উঠেছে ভারতে। ১৯৯৮ সালে ভারতের জিডিপিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবদান ছিল ১.২ শতাংশ, ২০২০ সালে ছিল ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি গত এক দশকে চোখে পড়ার মতো। অন্যতম খ্যাতনামা সংবাদ প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০১১ থেকে ২০১৯, প্রতিবছর বিশ্বের অন্য দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। বড় অংশই আসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক-শিল্প থেকে। পাশের ভারত ও পাকিস্তান থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বলা হয়েছে, মহামারি-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪০ শতাংশ হবে। ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ হবে তাদের জিডিপির ৯০ শতাংশের মতো।

আগামী বছরগুলোতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর তথ্যের বহুমুখী ব্যবহার বিশ্বব্যাপী জীবন ও জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন, বিপণন, যোগাযোগ, চিকিৎসা থেকে কৃষি—সব ক্ষেত্রেই যন্ত্র ও সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়বে। এখন আপনার মোবাইল, কম্পিউটার, ঘড়ি, টেলিভিশন বা গান শোনার স্পিকার ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত আছে। এই তালিকায় আস্তে আস্তে যুক্ত হচ্ছে আপনার গাড়ি, চোখের চশমা, ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, এমনকি জামাকাপড়ও। ফ্রিজে খাবার ফুরিয়ে আসতে শুরু করলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার পছন্দের দোকান থেকে খাবার চলে আসবে উবার বা পাঠাওয়ের মাধ্যমে।

জ্বর হয়েছে? থার্মোমিটারে নির্ণীত তাপমাত্রা ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিৎসকের কাছে চলে যাবে। চিকিৎসকের ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন যাবে ফার্মেসিতে। সেখান থেকে রোগীর কাছে ওষুধ আসবে ট্যাক্সিতে। দেখা গেল, একই এলাকায় হঠাৎ অনেকের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করল, অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ। সারা দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক চালু করা সম্ভব। এখনই হাতের স্মার্টফোনে ইসিজি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ফলাফল উদ্বেগজনক হলে মুহূর্তে সেই তথ্য চলে যাচ্ছে হাসপাতালে। চলে আসছে অ্যাম্বুলেন্সসহ ডাক্তার।

নির্ভুলভাবে অনেক আগে থেকেই অনুমান করা যাবে আমে পোকা লাগবে কি না, আর তার প্রতিকারই বা কী। মনে রাখতে হবে, এই পরিবর্তন বিশ্বের সব দেশে একসঙ্গে হবে না। পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকবে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা অব্যাহত রাখতে তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষ করে প্রোগ্রামিং, গণিত ও পরিসংখ্যানের মতো বিষয়গুলোতে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে দরকার সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, বিশ্লেষণী শক্তি আর নেতৃত্বদানের গুণাবলি। সঙ্গে সহমর্মিতা।

সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি হলো উবার, কিন্তু নিজেদের কোনো ট্যাক্সি নেই। সবচেয়ে বড় দোকান আমাজন, তাদের কোনো প্রথাগত দোকান নেই। আপনার হাতে যে স্মার্টফোনটি রয়েছে, তার মধ্যে ক্যামেরা জিপিএস, গান শোনা, এমনকি রোগ নির্ণয় করার যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ধরনের পণ্য বা সেবা বাজারে নিয়ে আসার জন্য কী দরকার? সৃজনশীলতা আর কল্পনা। প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে উবার আর আমাজনের সেবা প্রদানের জন্য। একই কথা প্রযোজ্য স্মার্টফোনের ক্ষেত্রেও। 
সৃজনশীলতা আর কল্পনাশক্তি কি শেখানো যায়? উত্তরটা হলো, হ্যাঁ! সৃজনশীলতা হলো একটা প্রক্রিয়া। যেকোনো বয়সে এটা শেখা যায়। আর শেখানো যায় সবখানে—স্কুলে, বাড়িতে, কাজের জায়গায়। তবে যত আগে শুরু করা যায় ততই ভালো। শিশুদের কেন, কীভাবে—এসংক্রান্ত প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রথার বাইরে চিন্তা করার জন্য কল্পনাশক্তিকে উৎসাহিত করতে হবে। বাড়াতে হবে পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার প্রবণতা। বই কল্পনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা দুটোই বাড়ায়।

ভবিষ্যতের প্রয়োজন বা কোনো সমস্যা আগে থেকে শনাক্ত করা এবং তার সমাধান ঠিক করতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্কিল। সত্তর-আশির দশকে ভারতের কিছু উদ্যোক্তা বুঝতে পেরেছিলেন, সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। বাকিটা ইতিহাস।

ভবিষ্যতের সমস্যা বা প্রয়োজন আগে থেকে অনুধাবন করা, বোঝা, ছোট ছোট অংশে ভাগ করা, তারপর সমাধান খুঁজে সবচেয়ে ভালো সমাধানের প্রয়োগ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণেরা বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদের দিকে যাচ্ছেন। খুবই আশাব্যঞ্জক। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের আধুনিক সংরক্ষণ, সরবরাহ আর বিপণন নিয়ে এখনই কাজ করতে পারেন উদ্যোক্তারা। ভবিষ্যতে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন দেশের মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ কর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ওপরের উদাহরণটি ধরুন। এ রকম একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে দরকার কম্পিউটার প্রোগ্রামার, পণ্যের চাষাবাদে অভিজ্ঞ চাষি, হিমাগারের নকশা করতে পারেন এমন স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার, আবহাওয়াবিদ, বিপণন বিশেষজ্ঞ, সরবরাহ বিশেষজ্ঞ এবং আরও অনেকে। এঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারে, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন। সঙ্গে দরকার সহনশীলতা আর মানবিকতা। যিনি কিনা অন্যের কথা মন দিয়ে শুনতে পারেন। অভিজ্ঞ লোকের কথা শুনে, নিজের মতামত আর ধারণাকে পরিবর্তন করাও অত্যন্ত জরুরি আগামী দিনের নেতৃত্বের জন্য। এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী চাহিদার তুলনায় দক্ষ পেশাজীবীর ঘাটতির সংখ্যা সাড়ে আট কোটি। ইউরোপ ও আমেরিকায় বয়স্ক মানুষের আধিক্য, নিম্নমুখী জন্মহার আর নতুন প্রযুক্তি এর বড় কারণ। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান এই অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের জন্য এক দারুণ সুযোগ তৈরি করছে। এই সুযোগ নিতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। আর প্রয়োজন কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের, যাঁরা নিজেরা স্বপ্ন দেখবেন আর অন্যকে স্বপ্ন দেখতে শেখাবেন। 

ড. সুব্রত বোস
বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত