Ajker Patrika

ভাঙার চেয়ে গড়াই যেখানে বেশি

শাখাওয়াত উল্লাহ
ভাঙার চেয়ে গড়াই যেখানে বেশি

বন্যার আঘাত আর ভাঙনের ক্ষত কোনো দিনও শুকায়নি নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে। নদীভাঙনের তাণ্ডবে সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এই উপকূলের মানুষকে। ভিটেহারা হয়ে কেউ আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে; কাউকে হতে হয়েছে দেশান্তরি। নোয়াখালীর অধিকাংশ জমি ছিল লবণাক্ত। এসব জমিতে ফসল হতো 
না। জীবন বাঁচাতে তাই শুরু থেকেই সংগ্রামী নোয়াখালীর মানুষ।

 ঝড়–জলোচ্ছ্বাস আর বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এখানকার মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই কঠোর পরিশ্রমী। এই পরিশ্রম এখন ফল দিচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় সহায়তা। গত এক যুগে নোয়াখালীর রূপ বদলে দিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট বা যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও কৃষি। আর সব সময়ই প্রবাসী আয় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে রাখছে সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

১৭৭২ সালে ইংরেজ আমলে পুরো দেশে ছিল মাত্র ১৯টি জেলা। এর মধ্যে ছিল নোয়াখালী। তখন অবশ্য নাম ছিল কালিন্দা। তারপর নাম ছিল ভুলুয়া। ১৮৬৮ সালে ভুলুয়াকে নোয়াখালী নামকরণ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে নোয়াখালী থেকে আলাদা করে ফেনী ও লক্ষ্মীপুর নামে নতুন দুটি জেলা করা হয়। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার আয়তন ৪২০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি।

একদিকে লবণাক্ত জমি, অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়া। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষিতেই পিছিয়ে ছিল নোয়াখালী। এখানকার মানুষ জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। পৃথিবীর নানা দেশে নোয়াখালীর প্রায় ৪ লাখের বেশি মানুষ কাজ করেন। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই নোয়াখালীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষার প্রসার, উৎসব-পার্বণে প্রবাসী আয়নির্ভর। কোম্পানীগঞ্জ, চাটখিল, বেগমগঞ্জসহ নোয়াখালীর প্রায় সব উপজেলায় রয়েছে প্রবাসীদের আলাদা সংগঠন। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও উপজেলাভিত্তিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন উপজেলাগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও দারিদ্র্যদূরীকরণের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

নোয়াখালীর শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানকার মানুষের মধ্যে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। দুর্গম চরাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। যদিও এর আগে থেকে দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সহজ হয়েছে।

নোয়াখালীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া উপজেলা সুবর্ণচর থেকে বছর দশেক আগেও দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত; সেখানে বর্তমানে এই উপজেলা থেকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কয়েক বছর ধরে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় পুরো নোয়াখালীবাসীর জন্য এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এখানে বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়ার ও পরীক্ষাকেন্দ্রে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়।

আগেই বলেছিলাম লবণাক্ত মাটি, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে এখানে কৃষিব্যবস্থা তেমন সুবিধার ছিল না। তা ছাড়া, নদীভাঙনের তাণ্ডবে দিশেহারা মানুষের কৃষিতে সফল হওয়া এক অলৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই বাধা ডিঙিয়ে নোয়াখালীর কৃষি এখন দেশের জন্য দৃষ্টান্ত। বছর দশেক আগেও যেখানে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থেকে যেত, সেখানে এখন প্রায় সব জমিতেই চাষাবাদ হচ্ছে। ৮ বছরে নোয়াখালীতে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ, যা ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। ১২ বছর আগের তুলনায় এখানে পুকুর বা খামারে মৎস্য উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

একই সঙ্গে পোলট্রি ও গবাদিপশু পালনের সংখ্যাও বেড়েছে। বৈচিত্র্য এসেছে রবিশস্য চাষে। লবণাক্ত জমি বলে আগে যেখানে জমি অনাবাদি থাকত, সেখানে এখন তিনটি ফসল হয়। তরমুজ, সূর্যমুখী, সয়াবিনের মতো ফসলে ভরপুর এখন রবি মৌসুম। মৌসুমি ফল উৎপাদনেও আগ্রহী হয়েছে মানুষ। এ ক্ষেত্রে সেচ, সার ও সরকারি সহায়তা ভূমিকা রেখেছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০০৩–০৪ সালের দিকে একটি ম্যাজিক ফসল চাষাবাদ করা হয়। এই ম্যাজিক ফসলটির নাম তরমুজ। সুবর্ণচরের অধিকাংশ কৃষক তরমুজ চাষ করে ভাগ্য বদলেছেন। যেখানে আগে প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ছিল কাঁচা বা কুঁড়েঘর, এখন সেখানে ৫০ শতাংশ বাড়ি পাকা বা ইটের তৈরি। কুঁড়েঘর কদাচিৎ চোখে পড়তে পারে। তরমুজ ছাড়াও এখানে সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ নানান ফসলের চাষাবাদ ব্যাপক বেড়েছে।

বিদ্যুতের সংযোগ ২০০৮ সালের পর থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ফলে নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর সঙ্গে সেতু, কালভার্ট ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নও হয়েছে ব্যাপকভাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সড়কও এখন পাকা।

যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদির উন্নয়নের ফলে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রায় সব বিষয়ে নোয়াখালীতে অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের জীবনমান পরিবর্তনে এ সবকিছু একই সুতোয় গাঁথা। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের মতো নোয়াখালীও এসব দিকে উন্নতি করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর কৃষি এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব বিস্তার করেছে, তার উল্লেখ বিশেষভাবে করতে হবে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেলে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েও দুনিয়াকে জানান দেবে নতুন নোয়াখালী। 

শাখাওয়াত উল্লাহ, গণমাধ্যমকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

রাখাইনে মানবিক করিডর কি প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ হবে, ভারত-চীন কীভাবে দেখবে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত