Ajker Patrika

‘টুলের ওপর চুলা থুইয়া পানিত দাঁড়ে রান্দি’

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রামের বন্যা দুর্গত এলাকা থেকে ফিরে
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৩, ২৩: ৪৬
Thumbnail image

‘ঘরের ভেতরত, বাইরত পানি। রান্দনের জায়গা নাই। টুলের ওপর চুলা থুইয়া পানিত দাঁড়ে রান্দি। কিন্তু ভাত খাওনের তরকারি নাই। কোনো বেলা লবণ দিয়া, কোনো বেলা কাটলের বিচি দিয়া ভাত খাওন লাগে। একবেলা রান্দি তিনবেলা খাই। খাওনের পানি আনা লাগে দূর থাইকা। খুব কষ্টে আছি।’ কথাগুলো বলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরের বানভাসি গৃহবধূ রাবেয়া খাতুন (৫০)।

আজ রোববার দুপুরে রাবেয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির আঙিনায় নৌকা ওপর দাঁড়িয়ে কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন রাবেয়া। ঘরে তাঁর অসুস্থ ও বৃদ্ধ স্বামী সুলতান।

রাবেয়া জানান, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানিবন্দী তাঁরা। পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি। শুধু রান্না আর তরকারির কষ্ট নয়, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শৌচাগার সংকট তাঁদের কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজগার না থাকায় বাজার-সদাই করার সামর্থ্য নেই তাঁদের।

রাবেয়া-সুলতান দম্পতির মতো মুসার চরের অন্য পরিবার তো বটেই, কুড়িগ্রামের শত শত বানভাসি পরিবারের অবস্থা এমনই। উঁচু স্থান কিংবা নৌকায় করে দিনাতিপাত করলেও বিশুদ্ধ পানি, তরিতরকারি আর গবাদিপশুর খাবার সংকট নিয়ে বিপাকে বানভাসি পরিবারগুলো। নদীর ঘোলা পানির সঙ্গে বসবাস করা পরিবারগুলো শুকনো স্থান, জ্বালানি, পর্যাপ্ত খাবার আর বিশুদ্ধ পানীয়-জলের অভাবে সংকটে দিনযাপন করছে।

মুসার চরের পরিবারগুলোর অবস্থা জেনে রওনা হই দক্ষিণ-পূর্ব বালাডোবা গ্রামের উদ্দেশ্যে। সেখানকার ২৫ পরিবারের অবস্থা আরও করুণ। বসতঘরে হাঁটু থেকে বুক সমান উচ্চতায় পানি। টিউবওয়েল, শৌচাগার সব পানির নিচে। কোনো কোনো পরিবার গবাদিপশুসহ এক চালার নিচে বসবাস করছেন। সেই চালায় একসঙ্গে খাবারও খাচ্ছেন, রাত্রী যাপন করছেন। এমনকি বাড়িতে পোষা মুরগিগুলো তাঁদের সঙ্গে আবদ্ধ। এমনই এক পরিবার হযরত আলী আর লালবানু দম্পতির। 

লালবানু জানান, তাদের কষ্টের সীমা নেই। প্রায় একমাস ধরে তারা পানিবন্দী। ঈদের আগে বাড়িতে পানি ওঠে। সেই পানি নেমে যেতে না যেতে আবারও বন্যার কবলে পড়ে তাঁদের গ্রামের সব কটি পরিবার। রান্না, জ্বালানি, গৃহস্থালি কর্ম এমনকি খাবার পানির সংকটে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা। শৌচাগার সংকটে নারী ও কিশোরীদের অবস্থা বেগতিক। 

লালবানু বলেন, ‘থাকার কষ্ট, খাবার কষ্ট। রান্দনের খড়ি নাই। পানিও আনন লাগে দূরের চর থাইকা। আইজ কয়দিন থাইকা বাচ্চাগো লইয়া গরুর ঘরে গরুর লগে বসবাস করতাছি। এহানেই একবেলা রাইন্দা তিন বেলা খাই। এই কয়দিনে খালি একবার ১০ কেজি চাইল পাইছি। তরিতরকারি আর পানির খুব কষ্ট হইয়া গেছে।’

‘চাইরপাশে পানি। রাইতে শ্যালো নৌকার শব্দ শুনলে ডর লাগে। না জানি চোর আইসা বর্গা নেওয়া গরু দুইডা নিয়া যায়। আমগো কষ্ট আর সমস্যার শ্যাষ নাই।’ সংকটের সঙ্গে আতঙ্কের কথাও বলেন লালবানু। 

দক্ষিণ-পূর্ব বালাডোবা গ্রামের আরেক বানভাসি আমজাদ আলী (৬২)। তিনি একই সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, ‘চাইলের সঙ্গে ডাইল আর আলু দিলে আমগো কিছুটা উপকার হইলো হয়। আর এহানকার মাইষের ভিটা উঁচা করি দিলে এতো কষ্ট কইরা থাকন লাগতো না।’ 

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বালাডোবা গ্রামে অনেক বাড়িতে উঠেছে বন্যার পানিদক্ষিণ-পূর্ব বালাডোবা গ্রাম থেকে ফিরে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর বালাডোবা, ফকিরের চরসহ কয়েকটি চরে গিয়ে বানভাসিদের নিদারুণ কষ্টের চিত্র দেখা গেছে। সবার মুখে খাবার পানি আর রান্নার সংকটের কথা। জ্বালানি, উঁচুস্থানের অভাবে রান্না আর গবাদিপশু নিয়ে পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। এর সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় চরে আবাদ করা চিনা, কাউন ও তিলসহ বিভিন্ন শস্য পানিতে তলিয়ে গেছে। সেগুলোর ফসল ঘরে তোলার কোনো আশা হারিয়েছে এসব চরবাসী। 

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলমান বন্যায় জেলার ৯ উপজেলায় ৪৫ ইউনিয়নের ১৮৫ গ্রাম কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের ৬১ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। আজ রোববার পর্যন্ত জেলায় বন্যা দুর্গত ও ভাঙন কবলিতসহ ২২ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে সরকার। আগামী কয়েক দিন নাগেশ্বরী, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি বিরাজমান থাকতে পারে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার প্রধান প্রধান নদ নদীর পানি হ্রাস পেয়েছে। আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নদনদীর পানি হ্রাস অব্যাহত ছিল। ওই সময়ে দুধকুমার নদের পানি কমে পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং ধরলার পানি কমে সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পানিও নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি প্রবাহ আরও কমতে পারে। 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রে আসা পরিবারগুলো বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। আশা করছি আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’ 

বানভাসিদের খাবার পানি ও তরকারি সংকটের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ জোরদার করার পাশাপাশি নগদ অর্থ দিয়ে বানভাসিদের জন্য ডাল ও আলু জাতীয় সবজি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত