Ajker Patrika

‘খালি আইসে ছবি তোলে, ব্রিজ হয় না’

জাহিদুল ইসলাম, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা)
Thumbnail image

‘খালি আইসে (আসে), আর ছবি তুলি নিয়া যায়। মাস যায়, বছর যায় হামার (আমার) ব্রিজ হয় না। এমাকে (তাকে) বান্দি (বেঁধে) থোন। এখন থাকি যাই (যে-ই) আইসবে, তাকে বান্দি থোয়া নাইগবে (লাগবে)। তা ছাড়া হামার ব্রিজ হবার নয় (হবে না)।’ সরকারি লোক ভেবে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ভেঙে যাওয়া নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর পাশে কাপড় কাচতে ব্যস্ত কল্পনা বেগম (৩৫)।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দা নামাপাতা গ্রামের বাসিন্দা কল্পনা বেগম। যে সেতু নিয়ে এত ক্ষোভ, সেখানে এখন পারাপারের জন্য আছে একটি বাঁশের সাঁকো, যা আবার ভেঙে গেছে। বুড়াইল নদীর এই সাঁকোর উত্তর পাশের গ্রাম খোর্দ্দা নামাপাতা। বহুদিন ধরেই এখানে একটি সেতুর দাবি স্থানীয়দের। কিন্তু এই দাবির বিপরীতে তাঁরা শুধু আশ্বাসই পেয়েছেন।

পরিচয় পাওয়ার পর কল্পনা বেগম বললেন, ‘এমন কোনো এমপি, টিউএনও (ইউএনও), চেয়ারম্যান ও মেম্বার নাই, যাই এটে (যে এখানে) আইসে নাই। খালি আইসে আর দেখি কয়, খুব তাড়াতাড়ি এটা করি দেমো। চিন্তা করেন না। এখন মনে হয় ওমরাগুলা (তারা) হামার সাথে তামাশা করেন। তোমরায় কনতো সাংবাদিক ভাই, এখন হামার ছাওয়াগুলা ক্যামন করি স্কুল যায়? কয়দিন থাকি (কিছুদিন ধরে) তামার (তাদের) স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়া আছে।’

সুন্দরগঞ্জের বুড়াইল নদীর ওপর ভেঙে যাওয়া বাঁশ ও কাঠের সাঁকো। এ ক্ষোভ শুধু কল্পনা বেগমের নয়। বুড়াইল নদীর দুপারের ২০ গ্রামের হাজারো মানুষের। একই গ্রামের মৃত আজিম উদ্দিনের ছেলে মানিক ব্যাপারী (৩০) বলেন, ‘জন্মের পর থেকে এখানে কখনো কাঠের সাঁকো, আবার কখনো বাঁশের সাঁকো দেখছি। সেটিও করা হয় এলাকার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজস্ব অর্থায়নে। প্রতি বছর দুবার করে করা হয় সংস্কার। তখন কেউ পাশে থাকে না। তবে ভোটের সময় হলেই প্রার্থীরা ফেরেশতা হয়ে অবতরণ করেন বুড়াইল নদীর এই সাঁকোর পারে। সুন্দর সুন্দর কথা বলেন তাঁরা। ভোট দিয়ে স্বপ্ন দেখি এবারে হয়তো আমাদের চলাচলের একটা সুব্যবস্থা হবে। কিন্তু সেটি কখনো হয়নি। বরং নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা আর আমাদের খোঁজ নেন না। এটাই সত্য কথা।’ 

সাঁকো মেরামত ও নির্মাণে কেন স্থানীয় প্রশাসনকে পাশে পাচ্ছে না মানুষ জানতে চাইলে তারাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে কমপক্ষে ১০টি এ ধরনের সাঁকো আছে। প্রতি বছর সেগুলো মেরামত করতে হয়, যা পরিষদের পক্ষে সম্ভব না। সে কারণে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সেগুলো মেরামত করা হয়। তবে ব্রিজ নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখেছি।’ 

জানা গেছে, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বজরা ও গুনাইগাছসহ তিনটি ইউনিয়নের সংযোগ সড়ক এটি। তারাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দা, চর খোর্দ্দা, লাঠশালা, বৈরাগী পাড়া, মন্ডলপাড়া গ্রাম এবং বজড়া ও গুনাইগাছ ইউনিয়নের চরবিরহীম, সাধুয়া, দামারহাট, নাগড়াকুড়া, কালপানি, হুকাডাঙ্গা ও থেথরাসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ এ পথ ধরে চলাচল করেন। দুই উপজেলার সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী, হাঁটুরে, বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এ পথ দিয়ে দৈনন্দিন যাতায়াত করে। 

খোর্দ্দা নামাপাতা গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেছে বুড়াইল নদী। নদীটি ছোট হওয়ায় বাঁশের সাঁকো আবার কখনো কাঠের সাঁকো দিয়েই চলত গ্রামবাসীর যাতায়াত। কিন্তু পরে তিস্তা নদী ভেঙে বুড়াইলে পানিপ্রবাহ বাড়ে। বেড়ে যায় বুড়াইল নদীর প্রস্থও। পরিচিতি পায় তিস্তার শাখা নদী হিসেবে। তখন থেকেই নদী পারাপারের জন্য সেতু নির্মাণের দাবি আরও জোরালো হয়। কিন্তু এর বিপরীতে শুধু আশ্বাসই মিলেছে। কাজের কোনো কাজ হয়নি। ২২ বছর ধরে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোই এ নদী পারাপারের একমাত্র অবলম্বন। প্রতি বছরই এ সাঁকো ভেঙে যায়। প্রতি বছরই নতুন করে গড়তে হয়। আর সংস্কার তো লেগেই আছে। বছরে অন্তত দুবার এ সাঁকো সংস্কার করা লাগে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। 

সুন্দরগঞ্জের বুড়াইল নদীর ওপর ভেঙে যাওয়া বাঁশ ও কাঠের সাঁকো। স্থানীয় মানিক ব্যাপারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, মাস দু-এক আগ থেকে সাঁকোটি নড়বড়ে হয়ে যায়। ঝুঁকি জেনেও এর ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে গত ১৫ দিনে কমপক্ষে পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটে। ইদানীং নদীর স্রোতে কচুরীপানা ভেসে আসে। নড়বড়ে সাঁকোর খুঁটিতে তা চাপ দেয়। এসব কারণে আগে থেকেই দুর্বল খুঁটি ভেঙে সপ্তাহখানেক আগে সাঁকোটি ভেঙে নদী পড়ে। এখন ভয়াবহ দুর্ভোগে রয়েছেন এ নদীর দুপারের মানুষ। 

তবে বিদ্যমান সাঁকোর জায়গাতেই সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিলেন উপজেলা প্রকৌশলী শামছুল আরেফীন। তিনি বলেন, ‘যেখানে সাঁকো রয়েছে, সেখানেই স্থায়ীভাবে ব্রিজ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই নির্মাণ করা হবে।’ 

একই রকম আশ্বাস দিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটওয়ারী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণে তালিকা পাঠানো হয়েছে। করোনার কারণে দেরি হচ্ছে। তবে আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে হয়ে যাবে।’ বর্তমান সংকট মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দ্রুত ওখানে বাঁশের সাঁকো করে দেব। ব্রিজ না হওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত