Ajker Patrika

‘হামরা দিবস দিয়ে কী করমো, কাম করে ভাত খাই’

আনোয়ার হোসেন শামীম, গাইবান্ধা
গাইবান্ধায় ইট ভাঙার কাজ করছেন এক নারী শ্রমিক। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাইবান্ধায় ইট ভাঙার কাজ করছেন এক নারী শ্রমিক। ছবি: আজকের পত্রিকা

মে দিবস এলে দিনটিতে শুধু দিবসই পালন হয়, মজুরি বাড়ে না। এমন অভিযোগ দিনমজুরদের। তাঁরা বলছেন, দিন–রাত সমানতালে কাজ করে যেমন ফুরসত মেলে না, ঠিক তেমনি বাড়ে না তাঁদের মজুরি। দ্রব্যমূল্য অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি না পেয়ে তাঁদের সংসারে টানাটানি। দিবসটি ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন আয়োজনে পালন করছেন। তবে শ্রমিকদের গা থেকে ছোড়া ঘামের ন্যায্যমূল্য দিতে কেউ রাজি নন। সভা-সেমিনারে বক্তব্যে ন্যায্য মজুরির কথা গলা ফেঁটে বললেও কোনো দিন বাস্তবায়ন হয়নি। ন্যায্য মজুরি মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নারী-পুরুষ উভয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও তাদের শ্রমের মূল্য আরও অনেক কম।

আজ মে দিবসেও ইট ভাঙা কাজ করছেন ৫০ বছর বয়সী খুশি বেওয়া। স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। তিন সদস্যের সংসার। ২০ বছর ধরে তিনি নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কাজ করলে দিনে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ টাকা আয় করেন। তাঁর আয়ের টাকা দিয়েই সংসার চলে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গাইবান্ধা জেলা শহরের গোডাউন এলাকায় ইট ভাঙার কাজ করতে দেখা গেছে তাঁকে। মে দিবস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ‘হামরা দিবস দিয়ে কী করমো। কাম করলে ভাত জোটে, না করলে উপোস থাকতে হয়।’

শ্রমিক শামসুল (৫৫) বলেন, ‘গরিব মানুষের আবার শ্রমিক দিবস। এক দিন কাম না করলে পেটে ভাত যায় না। শুধু দিবসই পালন হয়, আমাদের ন্যায্য মজুরি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নাই। কাকে বলব দুঃখের কথা, প্রতিবছর এভাবেই যায় মজুরি বাড়ে না। এক দিন কাজ না করলে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের। তারা বোঝে না শ্রমিক দিবস।’

অন্যদিকে ১৫ বছরের খায়রুল ইসলাম রিকশা চালাচ্ছেন। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার অদূরে প্রধানের বাজার এলাকার হাজারি গ্রামে। বাবা আয়নাল হক একজন কৃষিশ্রমিক। ছোট দুই ভাই ও এক বোনকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। বাবার সামন্য আয়ে সংসার চলে না। সংসারের বড় ছেলে সে। পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে খায়রুল ইসলাম রিকশা চালায়। জেলা শহরেই রিকশা চালিয়ে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে। মাসের ৩০ দিনই রিকশা চালাতে হয় তাকে। স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপাড়া করছে সে। খায়রুল বলে, ‘ছোট ভাই–বোন আছে, বাবার আয় দিয়ে সংসার চলে না। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু টাকার অভাবে বাকি লেখাপড়া করতে পারি নাই। পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে। আমি পরিবারের বড় ছেলে। দায়িত্ব আমার বেশি। ছোট ভাইরা তো আর কাজ করতে পারে না। কিস্তির ওপর টাকা নিয়ে রিকশা কিনেছি। প্রায় এক বছর থেকে রিকশা চালাই।’

এই উপজেলার ফারাজিপাড়ার রিফাদ মিয়া (১৪)। চার বছর ধরে ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করে। গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরিবারে অভাবে পরে আর স্কুলে ভর্তি হয়নি। ঝালাইসহ রডের যাবতীয় কাজ করে সে। রিফাদ জানায়, সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে সে।

খায়রুল ও রিফাদের মতো গাইবান্ধায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার বলে বেসরকারি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। তবে গাইবান্ধা জেলায় কী পরিমাণ শিশু শ্রমিক রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নেই।

গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শিশু শ্রমিকদের কাজের দৃশ্য দেখা গেছে, শহরের সার্কুলার রোডে আসাদুজ্জামান মার্কেট এলাকায় ফুলের দোকানে কাজ করছে নিরব মিয়া (১৫)। বাড়ি সদর উপজলার সরকারপাড়া এলাকায়। নিরব বলে, ‘পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। টাকার অভাবে আর লেখাপড়া করতে পারিনি। প্রায় পাঁচ বছর আগে চায়ের দোকানে কাজ করেছিলাম। এখন ফুলের দোকানে কাজ করি। দৈনিক ৩০০ টাকা হাজিরা পাই। এ দিয়েই চলে।’

একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। কী আর করি। বেশি লেখাপড়া করানো আমাদের পক্ষে সম্ভাব না। তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছেলেটাকে পাঠিয়েছি। বড় হয়ে কিছু একটা করে খেতে পারবে।’

শহরের গোরস্তান মোড়ে এলাকায় মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করে কবির হাসান (১৩)। বাড়ি শহরের পুলিশ লাইনস এলাকায়। কবির জানায়, ‘এক বছর লেখাপড়া করছি। পরে আর স্কুলে যাই নাই। পাঁচ বছর ধরে গ্যারেজে কাজ করছি। মোটরসাইকেলের অনেক কাজ শিখেছি। গ্যারেজে দৈনিক ২০০ টাকা পাই। এটি পরিবারের কাজে দেই।’

একই মার্কেটের ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করছে রাজিব মিয়া (১৬)। বাড়ি পুটিমারি এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করে সে। তার কাজটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মেশিন দিয়ে ঝালাইয়ের স্থানে পরিষ্কার করতে হয় তাকে। সে জন্যে সে অন্য শ্রমিকের চেয়ে বেশি টাকা পায়। তাই সে খোলা হাতে এ কাজ করে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা মো. মেহেদী বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে জেলায় কোনো প্রতিষ্ঠানেরই তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। পারিবারিক অস্বছলতায় অল্পবয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। এতে জেলায় ক্রমেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব শিশু বিভিন্ন গ্যারেজ, ওয়েল্ডিং মেশিন, লেদ মেশিন ও ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করছে। ফলে শিক্ষার আলো থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে এবং ঝুকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত হচ্ছে। একটি শিশু শ্রমিক গড়ে ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করছে। শিশুশ্রম বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। শিশুশ্রম কমানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১০-১২তম গ্রেডে নিয়োগ: প্রতি পদের বিপরীতে দুজন থাকবেন অপেক্ষমাণ

জনবল-সরঞ্জাম বেশি হলেও সমরশক্তিতে ভারত কি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

পাকিস্তানে কীভাবে হামলা চালাতে পারে ভারত, ইতিহাস যা বলছে

ইতিহাস গড়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে আইএসআইপ্রধান

সাবেক ‘র’-এর প্রধানের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত